হালদায় গত এক সপ্তাহে মরে ভেসে উঠেছে তিনটি গাঙ্গেয় ডলফিন। সর্বশেষ নদীতে ভেসে উঠা মরা ডলফিনটি পাওয়া যায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমেরঘাট এলাকায়। গতকাল পাওয়া ডলফিনটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ ফুট, ওজন ৬০ কেজি। এর আগের দিন বুধবার এই এলাকায় আরো একটি ডলফিন মরে ভেসে উঠেছিল। ১৪ জুলাই একটি ডলফিন মরে ভেসে উঠেছিল রাউজান পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গহিরা হালদা সংযুক্ত খালে। নদী পাড়ে বাসিন্দা ও নদীর জীববৈচিত্র রক্ষায় কাজে নিয়োজিত আছেন বা ছিলেন এমন বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন ডলফিন মৃত্যুর জন্য দায়ী নদীতে পাতা জাল। সকলেই মনে করছেন মাছ ও ডলফিন বাঁচিয়ে রাখতে হলে জাল পাতার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আরো কঠোর হতে হবে। বাড়াতে হবে নদী পাড়ের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত হালদায় ৩৮টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিচার্জ ল্যাবেটরি তথ্যানুসারে এই নদীতে ডলফিনের সংখ্যা ১৭০টি।
গত কয়েক বছর থেকে হালদার উপর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি ও জীববৈচিত্র রক্ষায় নদীতে অবৈধ তৎপরতায় লিপ্তদের বিরুদ্ধে অভিযানের মধ্যে এত ডলফিন কেন মারা যাচ্ছে এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদীর কাছে। তিনি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, সাঙ্গু, শিকলবাহা, কর্ণফুলী, চাঁনখালীতে প্রচুর ডলফিনের বিচরণ আছে, সেখানে তো ডলফিন মারা যাচ্ছে না।
এই গবেষক বলেন, আমি হালদায় ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি। তখন তো এভাবে ডলফিন মারা যায়নি। এখন হালদায় নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ হচ্ছে। অনেক গবেষক নদী ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজে আছেন। এত কর্মযজ্ঞের মধ্যে কিছু ডলফিন তো মারা যেতে পারে।
নদীর বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি তুলে ধরে এই গবেষক বলেন, শোনা যায় নদীতে কিছু মানুষ চিংড়ি শিকার করতে বিষ প্রয়োগ করে। এ কথা সত্যি হলে বিষক্রিয়ায় মারা যাওয়া চিংড়ি খেয়ে ডলফিনের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া নদীতে পাতা হচ্ছে মাছ মারার জাল, সেসব জালে আটকেও মারা পড়ছে ডলফিন। হতে পারে কোনো অসাধু চক্র ডলফিন মারা যাওয়ার এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নদীতে ডলফিন রক্ষার প্রকল্প নিয়ে আসার পরিকল্পনায় আছে।
তবে এই গবেষক নদীর মদুনাঘাট থেকে সর্তারঘাট পর্যন্ত এলাকায় জালপাতা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে কঠোর আইনের প্রয়োগ ও নদীর পাড়ের মানুষের মাঝে জনসচেতনা বাড়ানোর তাগিদ দেন। সর্তারঘাটের উপড়ের দিকে গরীব দুস্থ মৎস্যজীবিদের জীবন জীবিকার জন্য ছোট মাছ শিকারের জন্য উন্মুক্ত রাখার পরামর্শ দেন।
এই প্রসঙ্গে হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, এক সপ্তাহে তিনটি ডলফিনের মৃত্যু কখনো স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নদীতে পাতা জালে আটকে এসব ডলফিন মারা যাচ্ছে। যাদের জালে ডলফিন আটকে পড়ে তারা নিজেদের জাল রক্ষায় আঘাত করে অথবা দাঁড়ালো কিছু দিয়ে কুপিয়ে আটকে পড়া ডলফিনটি মেরে ফেলে। সম্প্রতি সময়ে মারা যাওয়া ডলফিন গুলো দেখে এর প্রমাণ মিলেছে। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, হালদার জীববৈচিত্র রক্ষায় জাল পাতার বিরুদ্ধে আরো কঠোর হতে হবে। ব্যাপক হারে জনসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। একাজে হালদা পাড়ের জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগাতে হবে।
হালদা পাড়ের জেলাপাড়ার মৎস্যজীবী বজহরি জলদাস বলেন, আমার চোখে দেখা ভেসে উঠা ডলফিনগুলোর অধিকাংশ ছিল গলিত অথবা অর্ধগলিত। শরীরের ছিল আঘাতের চিহ্ন। তিনি বলেন, অধিকাংশ প্রাণি মারা গেছে জালে আটকে। তার দাবি, এখনো রাতে পাতা হয় নদীতে জাল। নদী পাড়ে অনেকেই মাছ চোরদের তৎপরতা দেখলেও ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করেন না।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কাজে দায়িত্বে নিয়োজিত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী হালদায় ডলফিন মৃত্যুর ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনে আবহাওয়া জনিত কারণ বলে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, মানুষেরও তো মৃত্যু হয়। প্রাণী হিসাবে ডলফিনের আয়ুষকাল, রোগবলাই আছে, এসব প্রাণিরও মৃত্যু হতে পারে। তিনি বলেন, সম্প্রতি সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানি অত্যাধিক গরম। গরম পানি ডলফিনের সহ্য ক্ষমতা কম। এ কারণে ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুস সামাদ সিকদার বলেন, আমি নতুন যোগ দিয়ে কয়েকবার হালদা পাড়ে গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলেছি। ডলফিন মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছি। এ ব্যাপারে পরবতীতে করণীয় ঠিক করা হবে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহেদুল আলম বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি ডলফিন মৃত্যুর ঘটনায় উৎকন্ঠার মধ্যে আছি। বিষয়টি নিয়ে হালদা গবেষকদের সাথে আলোচনা করেছি। নদী পাড়ের মানুষের সাথে কথা বলেছিল। গবেষকগণ মনে করছেন জাল আটকে ডলফিন মারা যাচ্ছে। নদী পাড়ের অনেক মানুষ মনে করছেন আবহাওয়া জনিত কারণে এসব প্রাণির মৃত্যু ঘটছে।
যোগদানের এক বছরের মধ্যে হালদায় বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করার কথা জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এখন নদীতে কোনো ড্রেজার, বালু, পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে না। বিভিন্ন সময় জালও আটক করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।