অক্টোবর মাস বিশ্বব্যাপী ‘বেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস’ হিসাবে পালন করা হচ্ছে। বিশ্বসংস্থার একটি গবেষণায় প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ স্তন ক্যান্সারে মারা যায়। তাই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি খুব জরুরি।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, “সচেতনতাই ক্যান্সার প্রতিরোধের মূল শক্তি”। ক্যান্সার একটি জটিল রোগ হলেও, এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং প্রাথমিক শনাক্তকরণের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর এই প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সচেতনতা। ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা বলতে বোঝায়, ক্যান্সারের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জ্ঞান। কী কী কারণে ক্যান্সার হতে পারে, যেমন ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অতিরিক্ত ওজন, কিছু সংক্রমণ, এবং পরিবেশগত দূষণ।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে, আর দেরিতে নির্ণয় হলে চিকিৎসার জটিলতা ও খরচ বাড়ে, অন্যদিকে দ্রুত শনাক্ত হলে আরোগ্যের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
সাধারণ কিছু লক্ষণ যা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
–দীর্ঘস্থায়ী ও সহজে না সারা কোনো ক্ষত।
–শরীরের কোথাও চাকা বা পিণ্ডের উপস্থিতি।
–দীর্ঘদিন ধরে খুসখুসে কাশি বা স্বরের পরিবর্তন।
–মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে অস্বাভাবিক পরিবর্তন।
–অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ।
–অকারণে শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
আমাদের দেশের নারীদের অসচেতনতা, অবহেলা, পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময়ে নারী তার গোপনীয় অসুস্থতার কথাগুলো চেপে যায়। তখন সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। নারীর যে সমস্ত জায়গায় বেশি ক্যান্সার হয়, তা হলো–
নারীর জরায়ুমুখের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং মুখগহ্বরের ক্যান্সার–এই তিনটিই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। সঠিক সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এদের ঝুঁকি কমানো ও দ্রুত নিরাময় সম্ভব।
স্তন ক্যান্সার (Breast Cencer)
স্তন ক্যান্সার মহিলাদের মধ্যে ক্যান্সার সম্পর্কিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এবং বাংলাদেশে মহিলাদের মধ্যে আক্রান্তের দিক থেকে এটি শীর্ষে রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এর নিরাময়ের হার অনেক বেশি হয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে। ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। পারিবারে রক্ত–সম্পর্কিত আত্মীয়দের (মা, বোন বা বাবা) স্তন ক্যান্সার থাকলে ঝুঁকি বেশি। জেনেটিক মিউটেশন বা অন্যান্য জিনে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ত্রুটি থাকলেও ঝুঁকি অনেক বাড়ে। অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া (১২ বছরের আগে) এবং দেরিতে মেনোপজ হওয়া (৫৫ বছরের পরে) দীর্ঘস্থায়ী ইস্ট্রোজেনের সংস্পর্শে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সচেতনাতার উপায় হলো, প্রতি মাসে একবার নিজে নিজের স্তন পরীক্ষা করা। কোনো চাকা বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন অনুভব করলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, চিকিৎসকের মাধ্যমে নিয়মিত স্তন পরীক্ষা করানো।
ম্যামোগ্রাম, এটি স্তন ক্যান্সারের স্ক্রিনিংয়ের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি, বিশেষ করে ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সী মহিলাদের জন্য।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং শরীরের অতিরিক্ত মেদ নিয়ন্ত্রণ করা। ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা। প্রথম সন্তান দেরিতে বা সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানোও কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
নারীর জরায়ুমুখের ক্যান্সার
জরায়ুমুখের ক্যান্সার বাংলাদেশে মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তবে এটি এমন একটি ক্যান্সার যা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হলে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা সম্ভব এবং টিকা ও স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে সহজে প্রতিরোধ করা যায়।
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, এটি জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক থেকে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে এবং যৌন জীবন শুরু হলে ঝুঁকি বাড়ে। অধিক সন্তান প্রসবের ইতিহাস থাকলে। এইচআইভি সংক্রমণ বা অন্য কোনো কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। নিরাপদ যৌনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব।
সচেতনতা ও প্রতিরোধের উপায় হলো– HPV টিকা, ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের HPV টিকা নিলে জরায়ুমুখের ক্যান্সার অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়। টিকা দিলেও পরীক্ষা করা জরুরি। প্যাপ স্মিয়ার (Pap Smear), জরায়ুমুখের কোষ পরীক্ষা করে ক্যান্সার–পূর্ব অবস্থা বা প্রাথমিক ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। ২০ বছর বয়সের পর থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর এই পরীক্ষা করা উচিত। ভিআইএ (VIA- Visual Inspection with Acrticacid), এটি সহজে এবং কম খরচে করা যায় এমন একটি পরীক্ষা। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য বর্জন এবং নিরাপদ যৌন অভ্যাসে সচেতন থাকা।
মুখগহ্বরের ক্যান্সার
নারী–পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে এবং এটি বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান ক্যান্সার। এটি ঠোঁট, জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, তালু বা গালের ভেতরের যেকোনো স্থানে হতে পারে।
ধূমপান (বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা), ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, সাদাপাতা, গুল, খৈনি, পানবাহার) সেবন মুখগহ্বরের ক্যান্সারের প্রধানতম কারণ। অতিরিক্ত মদ্যপান ঝুঁকি বাড়ায়। মুখের অপরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, ধারালো দাঁত বা ভাঙা ফিলিং থেকে সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। নিয়মিত অতিরিক্ত গরম বা ঝাল খাবার ও পানীয় গ্রহণ। দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত রোদে থাকলে ঠোঁটের ক্যান্সার হতে পারে।
সচেতনতার জন্য সব ধরনের তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নিয়মিত প্রতিদিন দু’বেলা দাঁত ব্রাশ করা ও খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলকুচি করা। ধারালো দাঁত বা ভাঙা দাঁত দ্রুত ঠিক করে নেওয়া।
সপ্তাহে একবার আয়নায় নিজের মুখ, জিহ্বা ও মাড়ি পরীক্ষা করা। মুখের ভেতরে যেকোনো ধরনের ঘা, ক্ষত, চাকা, লাল বা সাদা দাগ যা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, তা দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
নিয়মিত ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতি ছয় মাস পরপর দন্ত চিকিৎসকের কাছে মুখগহ্বর পরীক্ষা করানো।
যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যেকোনো ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি।
ক্যান্সার একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও, এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সচেতনতাই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
সচেতন হোন, ক্যান্সার প্রতিরোধ করুন।












