সকলের প্রিয় মিন্টু ভাই

এক নিভৃতচারী সমাজসেবক

জিয়া হাবীব আহসান | শনিবার , ৩১ মে, ২০২৫ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রকাশ ‘মিন্টু ভাই’ নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে চিত্রটি মনে ভেসে ওঠে, তা হলো একজন নিঃস্বার্থ, প্রচারবিমুখ, কিন্তু অপরিসীম মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষ, যিনি তাঁর জীবনব্যাপী নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ও নিঃশব্দ সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন চট্টগ্রামের সমাজসেবার ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, মানব সেবক, সফল সংগঠক এবং শিল্পোদ্যোগের পথিকৃৎ। ধর্মবর্ণ, দলমতউঁচুনিচু সকল মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিউসি গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ব্যবসায়ে যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তা তাঁকে বিত্তশালী করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই বিত্তের গৌরব কখনোই তাঁর মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং তিনি নিজের অর্জিত সম্পদকে মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে সাহায্য করেছেন দুঃস্থ, অভাবী, কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার, মেধাবী শিক্ষার্থী ও রোগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ে। সমাজসেবা ছিল তাঁর প্রাণের ধ্বনি রাজনীতি তাঁর আয়ত্তে থাকলেও, তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে নিঃস্বার্থ সমাজসেবাকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পিতার নামে গড়া জনকল্যাণমূলক ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি সমাজে এমন সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যেগুলোর প্রতিটি ধূলিকনায় আছে তাঁর স্পর্শ, ভালোবাসা ও আত্মনিবেদন। চট্টগ্রামের শহর বন্দর ছাড়াও রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, চকোরিয়া, কর্তফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় তাঁর গড়া শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। এর মধ্যে রয়েছে: ২টি ডিগ্রি কলেজ, ৫টি হাই স্কুল, ২টি কিন্ডারগার্টেন, ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি এতিমখানা, ১টি দাতব্য মাতৃসদন, ১টি কমিউনিটি হল (বিনা ভাড়ায় ব্যবহারের জন্য), ৩টি হাই স্কুলে অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ভবন, ৩টি পৃথক লাইব্রেরি, অসংখ্য মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়ন কাজ এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরের একাধিক বড় বড় হাসপাতাল, এতিমখানা, জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তাঁর বড় অংকের অনুদান। এমনকি এসব কাজের প্রচারের জন্য তিনি কোনোদিন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কারণ, সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ এক মহৎপ্রাণ মানুষ। বিশ্বদর্শী এক মননশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানপিপাসু। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজনীতি ও বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তিগত পাঠাগারে ছিল দেশবিদেশের বিভিন্ন জার্নালে লেখকদের দুর্লভ পুস্তক সংগ্রহ। তিনি গান ভালোবাসতেন বিশেষত ক্লাসিক ও গজল। তালাত মাহমুদ, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, ভূপেন হাজারিকা, মেহেদী হাসান, রুনা লায়লা থেকে শুরু করে শাহ আবদুল করিম, হাসান রাজা সবাই ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পীদের তালিকায় ছিলো। চট্টগ্রামে অবস্থানকালে প্রিয়জনদের নিয়ে সন্ধ্যায় নিজের গুডস্‌হিলের বাসভবনে সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক চমৎকার আলোচনার আসর বসাতেন। বইপড়ার নেশা ও সংগীতের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে করেছিলেন এক রুচিবান, সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে। ব্যবসায়ী হয়েও কর্মচারীনিবেদিত বন্ধু ছিলেন তিনি। বড় শিল্পোদ্যোক্তা হয়েও তিনি ছিলেন কর্মচারীবান্ধব। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খোঁজখবর রাখতেন। তাঁদের সুখদুঃখে পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর মধ্যে ধনীনির্ধনের ভেদ ছিল না, বরং মমতার বন্ধনে সবাইকে জড়িয়ে রাখতেন। একটি উদাহরণচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম ব্যাচের সমাপনী উৎসবের স্মরণিকা ‘অনুরণন’এর প্রকাশকালে তিনি বিনা দ্বিধায় একটি বড়ো বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেন। তখন তিনি ছিলেন কনভেনর হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের অন্যতম প্রেরণাদাতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী উৎসব ১৯ তম ব্যাচের কনভেনর হিসেবে আমি দায়িত্বপালনকালে ‘অনুরণন’ নামক প্রকাশনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস তুলে ধরলে তিনি তার পিতার অবদানের পাশাপাশি অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলের অবদান ও ছবি ছাপানোর জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান এবং মহত্ত্বও বড়ত্বের পরিচয় দেন। এমন বহু কর্মকাণ্ডে তিনি থেকেছেন আড়ালে নীরবে, নিভৃতে। আমাকে স্নেহভরা কণ্ঠে ডাকতেন, ‘জিয়া, ভাই’ আজো কানে ভাসে তাঁর দরদ ভরা মায়াবী কণ্ঠ, তাঁর একান্ত সচিব মাহমুদ হাসান রুমি আমার মামাতো ভাই ও সহপাঠী হিসাবে সাইফুদ্দীন ভাইয়ের সাথে প্রায় যোগসূত্র ছিলো আমার সাথে। মরহুম সাইফুদ্দীন কাদের চৌধুরীর বড় বোনের জামাই ইঞ্জিনিয়ার মুনাওয়ার আহমেদ ছিলেন আমার মরহুম পিতা এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহয়্যার চট্টগ্রাম কলেজের পাঠ্য জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাঁর সাথে আমি বাংলাদেশ অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. নামক প্রাচীন সমবায় প্রতিষ্ঠানে পরিচালক (লিগ্যাল) হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ পাই। আমার আম্মার ফুফুর বাড়ি ও সাইফুদ্দীন কাদের চৌধুরী ভাইয়ের দাদার বাড়ি গহিরা একই গ্রামে পাশাপাশি। তাঁর পিতা পাকিস্তানের স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন এডভোকেট মরহুম এজাহার হোসাইন (বি.এল)। আমার বড় মামা বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবু মোহাম্মদ মঈনুদ্দিনকে সাইফুদ্দীন ভাই অসম্ভব সম্মান করতেন এবং তাকে মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আজীবন উক্ত স্কুলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল, মাত্র ৬০ বছর বয়সে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অকালপ্রয়াণে চট্টগ্রামের জনপদে নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর চলে যাওয়ায় সমাজ সেবার একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান ঘটে। তবে সাদকায়ে জারিয়া সমূহ জারি আছে, তাঁর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি সেই মহান মানুষটিকে, যিনি ছিলেন সমাজের নীরব দাতা, প্রচারবিমুখ কর্মবীর এবং মানবপ্রেমিক এক বিরল ব্যক্তিত্ব। সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী শুধুমাত্র একটি নাম নয় তিনি ছিলেন একটি অনুপ্রেরণা, একটি বটবৃক্ষ তুল্য একটি প্রতিষ্ঠান। সমাজসেবার যে উচ্চতর আদর্শ ও দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন, তা আজীবন পথ দেখাবে বীর চট্টগ্রামের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো আজও বহন করছে তাঁর স্বপ্নের আলো। তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা। মহান প্রভু মালিক তাঁকে দয়া করে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী মেহমান হিসাবে কবুল করুন আমিন।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, মহাসচিব

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনবিএইচআরএফ

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় আলীশাহ্‌ ভাইয়াকে স্মরণ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে