মানুষ নির্বাচন চায়। কেমন নির্বাচন চায়। ভোটের নির্বাচন। নিজের ভোট নিজে দেয়ার নির্বাচন। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারার নির্বাচন। বাধা বিঘ্নহীন নির্বাচন। যাকে খুশি তাকে ভোট দেয়ার নির্বাচন। নির্ভয়ে ভোট দেয়ার নির্বাচন। ভয় ভীতিহীন নির্বাচন। নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারার নির্বাচন। আনন্দঘন পরিবেশে নির্বাচন। উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচন। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনী পরিবেশ চায়। অবাধে প্রচার প্রচারণার নিশ্চয়তা চায়। সকল প্রার্থী যেন সমান সুযোগ সুবিধা পায় তার নিশ্চয়তা চায়। কোন দল বা প্রার্থীকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব না দেয়ার প্রতিশ্রুতি চায়। নির্বাচনের মাঠ সবার জন্য একই রকম চায়। সমতল বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চায়। যেখানে সকল প্রার্থী সমান তালে খেলতে পারে। সমানভাবে তাদের প্রচার প্রচারণা চালাতে পারে। কেউ কাউকে যেন বাধা দিতে না পারে। এক পক্ষ যেন আরেক পক্ষের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে না পারে। প্রতিপক্ষ যেরকম হোক না কেন সবাই যেন সমান গুরুত্ব পায়।
নির্বাচনের পরিবেশ অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি না হলে ভালো নির্বাচন করা যায় না। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অনেকটা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করে। একইসাথে নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী পক্ষগুলোর দায়িত্ব কোন অংশে কম নয়। রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা স্বাভাবিক। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে নির্বাচন জমে ওঠে না। নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ থাকে না। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে যেন দ্বন্দ্ব সংঘাত বা সহিংসতায় জড়িয়ে না পড়ে। যে কোন ধরনের সংঘাত সহিংসতা নির্বাচনী পরিবেশের বিঘ্ন ঘটায়।
নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা খুবই জরুরি। তাদের পক্ষপাতহীন থাকার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় সময় দেখা যায় যে দলের প্রার্থী জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেদিকে তাদের মনোযোগ থাকে। এমনকি নির্বাচনের সাথে যারা সরাসরি যুক্ত তাদের মাঝেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে প্রিসাইডিং অফিসার ও ভোটগ্রহণে নিয়োজিত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গও। যেসব প্রার্থী দাপট ও শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে চায় তাদের প্রতি কঠোর অবস্থান নিতে অনীহা দেখায়। প্রার্থীদের মাঝেও এক ধরনের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ ঘটে। এতে করে ভোট কেন্দ্রের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত হয়।
নির্বাচনকালীন সরকার নির্দলীয় হলেও প্রশাসন সবসময় নিরপেক্ষ থাকে না। সরকার যে ধরনের হোক না কেন প্রশাসনকে সর্বদা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রশাসন কখনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে পারে না। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ চিত্র অনেকটা ভিন্নতর। প্রশাসন নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। প্রার্থীর সরাসরি পক্ষ না নিয়েও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এতে করে ভোটারের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলন পুরাপুরিভাবে ঘটে না। নির্বাচনে এক ধরনের ম্যাকানিজম কাজ করে। অনেকে তাকে সূক্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং বলে থাকে। এর সাথে রাজনীতির ক্ষমতাধর কোন পক্ষ জড়িত থাকে। এ ধরনের নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিচয় বহন করে না।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা গেলেও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এতো সহজ নয়। কোন না কোনভাবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। ফ্রি ফেয়ার বলা হলেও নির্বাচন কখনো চাপমুক্ত হয় না, শঙ্কামুক্ত হয় না। বিভিন্নমুখী চাপ নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে চাপটা অনেক বেশি থাকে। প্রতিপক্ষ যদি সমান সমান হয় তাহলে নির্বাচনে বহুমুখী প্রভাব পড়ে। চাপের মাত্রাও বেড়ে যায়। ভোটারদেরকেও এ চাপের মধ্যে পড়তে হয়। সমর্থকদের মধ্যেও এক ধরনের শক্তিমত্তা প্রকাশের তৎপরতা দেখা দেয়। এমনকি সংঘাত ও হানাহানির প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোথাও চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। প্রতিপক্ষের পাল্টা পাল্টিতে ভোটাররা ভয় ভীতির মধ্যে পড়ে যায়। সহিংস ঘটনারও সূত্রপাত ঘটে। নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে না।
নির্বাচনকে অনেকে ভোট যুদ্ধ বলে। আবার অনেকে ভোটের লড়াই বলে থাকে। নির্বাচনে যেহেতু হারজিৎ আছে সেহেতু নির্বাচনকে ভোটের লড়াই বলা যায়। লড়াই কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয় না। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না হলে লড়াই হয় না। একতরফা নির্বাচন হয়ে যায়। সবাই ভোটে নামে জেতার জন্য। কোন পক্ষ হার মানতে চায় না। কীভাবে নিজের পক্ষে ভোট টানবে এর জন্য ওঠে পড়ে লাগে। প্রচার প্রচারণা চালাতে গিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কোন কোন সময় প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়। কেউ কেউ আবার পরাজিত হবে ভেবে ভোট স্থগিত করতে চায়। পরাজয়কে অনেকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। ভোটকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এজন্য নির্বাচনে প্রার্থীদের সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়।
বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল অংশ গ্রহণ করলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়। আবার কেউ কেউ বলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তবে বিরাজমান সকল রাজনৈতিক দল যে নির্বাচনে অংশ নেয় তাও নয়। বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দলের সাথে ব্যাপক জন সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না। ছোট ছোট কয়েকটি দল নিয়ে কোন একটি বড় দল নির্বাচন করলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এরকম নির্বাচনে ভোটাররাও ভোট প্রদানে আগ্রহী হয় না। কেননা ভোটারদের প্রার্থী নির্বাচনে বা পছন্দের সুযোগ থাকে না। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় ভোটাররা ধরে নেয় বড় দলের প্রার্থী এমনিতে হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে আশানুরূপ ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় না।
মানুষ যে ধরনের নির্বাচন চায় সেরকম নির্বাচন করা যায় কিনা তা বলা সহজ নয়। তবে তার চেয়ে বেশি কঠিন নির্বাচনকে সর্বসাধারণের নির্বাচনে পরিণত করা। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তেতে দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হয়। একইসাথে সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতামতকে সম্মান দেখানো। যার নাম গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। যার জন্য দেশের মানুষ দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে। ভোটের দিন মানুষ অবাধে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা দিতে পারলে নির্বাচন হয়ে যায়। দিন শেষে ফলাফলও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ভোট কেমন হলো সে আলোচনা থেকে যায়। মানুষের মাঝে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। ভোট নিয়ে নানা ধরনের কথা বার্তা চলতে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানামুখি খবরাখবর প্রচার হতে থাকে। পত্র–পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সব কেন্দ্রে যে একই রকম ভোট হয় তা নয়। কোন কোন কেন্দ্রে গণ্ডগোল হয়, ভোট স্থগিত হয়ে যায়, অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তারপরও বেশিরভাগ কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলা হয়। প্রার্থীদের মধ্যে যারা হেরে যায় তাদের অনেকে তা মানতে চায় না। আবার কোন কোন রাজনৈতিক দলও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মেনে নেয় না। এরা এতো বেশি সোচ্চার হয়ে ওঠে যাতে করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এজন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের ফলাফল মেনে নেয়ার মানসিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যেতে হলে বেশিরভাগ মানুষের রায়কে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী











