একটি নবজাতক স্রষ্টার কাছ থেকে বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে পৃথিবীতে আগমন করে। জন্মের পরে মায়ের ভালোবাসা, আত্মীয়ের স্নেহ–মমতায় কেটে যায় দুই–তিন বছর। ঘরের চৌকাঠ পার করে সখীদের সাথে হৈ–হুল্লোড় আর পাড়াগাঁয়ের জল–মাটির সাথে পরিচিত হতে হতে ছয়–সাতে পদার্পণ করে। দেশের আইন কিংবা সামাজিক প্রথা অনুযায়ী শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করে। অতঃপর কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আবার কেউ মাঝপথেই বিদ্যাবুদ্ধি ত্যাগ করে স্রষ্টাপ্রদত্ত ক্ষমতা প্রকাশে প্রবৃত্ত হয়। ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার শেষে ফলাফল রেখে যাত্রা করে অসীম অবকাশের দিকে।
মানুষের জীবনচক্র বলতে এতটুকুই। তবে বিশাল এই পৃথিবীতে জীবনের সামান্য সময়টুকু মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের পদচারণা লক্ষ্য করা যায়। যেমন– প্রশাসনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদির মতো উচ্চবিত্ত পেশাদারী কিংবা নিম্নবিত্ত পেশাদারিত্ব : যেমন– কৃষক, জেলে, কুলি, দিনমজুর ইত্যাদির ক্ষেত্রে। প্রতিটি মানুষের চিন্তা–চেতনা, জীবনযাত্রা, কর্মপদ্ধতি ভিন্ন হলেও কর্মচারী থেকে কর্মকর্তা, জেলে–কৃষক থেকে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার কিংবা নবজাতক শিশু থেকে মৃত্যুপথগামী বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের জীবনের আকাঙ্ক্ষিত চাহিদা একটাই ‘মানসিক প্রশান্তি’।
ক্রন্দনরত একটি শিশু সকলের মমতা উপেক্ষা করে মায়ের কোলে প্রশান্তি লাভ করে। একটু বড় হলে চিরপরিচিত সেই মায়ের আঁচল ছেড়ে বন্ধুদের নিয়ে অজপাড়াগাঁয়ের মাঠে–ঘাটে ছুটোছুটি করে আনন্দ পায়। শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে কেউ অর্থ উপার্জনে প্রবৃত্ত হয় আবার কেউ অর্থের মোহ ত্যাগ করে সাধারণভাবে জীবনযাপন করে। কেউ ধর্মের অনুসরণ করে আর কেউ স্রষ্টার আনুগত্য থেকে বিমুখ থাকে। মানুষের মাঝে এমন বৈষম্যের প্রধান কারণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিক প্রশান্তির ভিন্নতা।
তথাকথিত সামাজিক প্রথা অনুযায়ী অধিকাংশ মানুষই মনে করে মানুষের সুখের মৌলিক উপকরণ ‘অর্থ’। মূল্যবান গাড়ি, বাড়িসহ ব্যংকের কুঠুরিতে যার যত বেশি অর্থ সঞ্চিত আছে তার সুখের পরিমাণও তত বেশি। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অর্থাভাবের কারণে লেখকও এর বিপরীত ধারণা পোষণ করেন না। তবে কেবল সঞ্চিত অর্থই মানুষকে প্রশান্তি দেয় না বরং অর্থের শূন্যতাও কখনো কখনো মানসিক প্রশান্তির কারণ হয়।
অবাস্তব মনে হচ্ছে? ভাবছেন– ‘নিম্নবিত্ত লেখক বিত্তবান পাঠকদের মাহাত্ম্য স্বীকার না করে বরং নিজের দারিদ্র্যকে মহান করে তোলার চেষ্টা করছে।’ তবে শুনুন, আপনাদের একটি বাস্তব ঘটনা বলি –
অনার্স প্রথম বর্ষে রুটিনমাফিক আমাদের বিভাগীয় ক্লাস দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ক্লাসের মাঝে ৩০ মিনিটের জন্য মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দেয়া হয়। এসময়ে আমরা ক্যান্টিন বা ফাস্টফুডের দোকান থেকে আহার সম্পন্ন করি। মাসের শেষ দিকে একদিন ক্লাসের ফাঁকে বিরতিতে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে কিছু বাক্য আমার ভাবনা ও হাঁটার মনোযোগ ভঙ্গ করে। ‘সারাদিন খাই নাই। কিছু দিয়া যাও বাবা, আল্লা তোমার ভালো করবে।’ রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখি, কালো বোরকাবৃত বৃদ্ধা এক মহিলা গাছের ছায়ায় সম্মুখে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মূহুর্তের জন্য তার দিকে করুণা–দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুনরায় গন্তব্যের দিকে মনোনিবেশ করলাম। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দরিদ্র দেশে এরূপ ঘটনার সাথে আমরা পূর্বপরিচিত। প্রতিদিনই আমরা এসব করুণ দৃশ্যের মুখোমুখি হই এবং খুব সুক্ষ্মভাবে নিজেদের অসহায়ত্ব স্বীকার করে মনুষ্যত্বের মহানুভবতার সৎকার করি। তবে সেদিনের চিরপরিচিত অতি সাধারণ ঘটনাটুকুই যেন হৃদয়ে সামান্য আঁচড় কেটে দিগন্তের বিশালতায় হারিয়ে গেল। যেখানে হাজারো শব্দের প্রবন্ধ মনে সাড়া ফেলতে পারে না সেখানে মাত্র দুটি শব্দ ‘সারাদিন খাই নাই’। আমিওতো অভুক্ত, সাথে যা টাকা আছে তাতে অবশ্য এ বেলা হয়ে যাবে। এখন না খেলে ক্ষুধা পেটে আরো দুইটা ক্লাস করতে হবে। ততক্ষনাৎ একথাও ভাবনায় এলো, আমি অল্পবয়সী, এটুকু সময় হয়তো চেষ্টা করে থাকতে পারবো, বাসায় আমার জন্য মুখরোচক, সুস্বাদু কোনো খাবার হয়তো অপেক্ষা করছে, কিন্তু সে বৃদ্ধা, তার জন্য হয়তো একমুঠো ভাত নিয়ে কেউ অপেক্ষা করে না কিংবা তার থাকার স্থানটুকুই নেই।
বাস্তব–অবাস্তবের এমন যোগ–বিয়োগের হিসাব কষাকষি শেষ করে ফলাফল না ভেবে আবার উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করলাম। পকেটের কোণে পড়ে থাকা পঞ্চাশ টাকা বৃদ্ধার হাতে দিয়ে দিলাম। পকেটের শূন্যতা আর পেটের ক্ষুধা নিমিষেই এক টুকরো হাসির আড়ালে হারিয়ে গেলো। ‘মানসিক প্রশান্তি’। এইতো সেই অমূল্য বস্তু, প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষ যার প্রতিক্ষা করে, যার জন্য মানুষ বেঁচে থাকে, যা না পাওয়ার আক্ষেপে মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। মহাবিশ্বের অন্তিম মুহূর্তের সর্বশেষ অক্সিজেনটুকুর মতো অতি সামান্য অথচ অমূল্য সেই বস্তুটি আমি পেয়েছি এবং অতি সাধারণের মাঝেই পেয়েছি। মাতৃত্বের অসীম মমত্বের মতো এরূপ আসক্তি আমি আরও পেতে চাই এবং বার বার পেতে চাই। আমার সন্তুষ্টিই যেন আমাকে সর্বদা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।