সময়ের ব্যবধানে দেশে যোগাযোগ অবকাঠামোয় লক্ষ উন্নতি হলেও সেগুলোর মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল দূরে থাক অল্প সময়েই সেগুলো হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু সড়ক নয়, সেতু-কালভার্টেরও একই অবস্থা। কিছুদিন পর পর দেশের নানা প্রান্তে সেতুর একাংশ দেবে গিয়ে বা ভেঙে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দেশের সড়ক-মহাসড়কের পাঁচ হাজারেরও বেশি বর্তমানে সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। খবরটি নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর উদ্বেগজনক। ত্বরিত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে যে কোন মুহূর্তে বড় বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা রয়েছে। কাজেই বিষয়টার ভয়াবহতা সামলে নিতে কর্তৃপক্ষের সক্রিয়তা কাম্য। আমাদের দেশে একটা নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায় যে সেতু, পুল, কালভার্ট অনেক অর্থব্যয় করে তৈরি হয়, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক সময় সামান্য মেরামতের কাজ করলেও ওই সব স্থাপনা রক্ষা করা যায়। অথচ একেবারে অচল সেই মেরামত কাজে এত খরচ হতো না। এতে খরচ যেমন বেড়ে যায়। তেমনি জনগণেরও ভোগান্তির অন্ত থাকে না। মূলত এসব বিষয় দেখা ও তদারক করার দায়িত্বে গাফেলতি ও অবহেলার কারণেই এটা হচ্ছে। এটা চলতে দেওয়া উচিত হবে না। সড়ক-মহাসড়কের সেতু-কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ)। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে সংস্থাটির অভ্যাসগত দীর্ঘসূত্রতার কারণ খতিয়ে দেখা এখন সময়ের দাবি। আমাদের দেশ প্রাকৃতিকভাবে বেশ দুর্যোগ প্রবণ। স্বাভাবিকভাবে এখানে কিছুদিন পর পর বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। এতে অনেক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সেতু কালভার্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দুর্যোগ প্রাকৃতিক হওয়া ত্যাগের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তা বলে মেরামতের সুযোগ নেই, এমন তো নয় দেরি না করে ক্ষতিগুলো যত সত্বর সম্ভব মেরামতের কাজে নেমে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এখন দরকার, কত ক্ষিপ্রতায় অবকাঠামোগুলো মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা যায় সেটি নিশ্চিত করা। বরাবরই এক্ষেত্রে সওজের বিলম্ব ও অদক্ষতা দেখা গেছে। এর অবসান হওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত যানবাহন ধাক্কা, অতিরিক্ত ওজনের গাড়ি চালাচলসহ মানবসৃষ্ট কিছু করলেও সেতুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এটা কাম্য নয়। সেতু পার হওয়ার সময় যানবাহনগুলোর নির্দিষ্ট গতি ও ওজনসীমা মেনে চলার নিয়ম। কিন্তু এ নিয়ম অনেক ক্ষেত্রে যথযথভাবে পরিপালন হয় না। চলাচলকারী পরিবহনের চালকরা যেমন তা মেনে চলে না, আবার সেতু কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানও নিয়ম পরিপালনে নিশ্চিতে যথাযথ তদারকি জোরদার করে না। ফলে বেপরোয়া গতি ও অত্যধিক ওজনের ভারে সেতুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই অবকাঠামোর স্থায়িত্ব নিশ্চিতে উভয়পক্ষকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
তৃতীয় আরেকটি বিষয় হলো, নকশা ও নির্মাণত্রুটি। আমাদের দেশে সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীনতার ছাপ স্পষ্ট। বিশেষ করে নকশা ও নির্মাণত্রুটির বিষয়টি একটি বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এক দুটি নয় উপযর্ুুপরিভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে নকশা ও নির্মাণ ত্রুটির ঘটনা সামনে এসেছে। এটা পরিতাপের বিষয়। যে কোনো অবকাঠামোর স্থায়িত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে এর নকশাগত সঠিকতা ও নির্মাণ শৈলীর ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের নির্মাণকাজের অবস্থা দেখলে মনে হয়, এখানে অবকাঠামো পরিকল্পনায় বিষয়টি যথাযথভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে অন্তর্নিহিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকছে সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। মূলত প্রকৌশলগত অদক্ষতার কারণেই এমনটি হচ্ছে। অথচ এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। অবকাঠামোর স্থায়িত্ব নিশ্চিত ও সম্ভাব্য ঝুুঁকি এড়াতে এদিকে নজর দিতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো রক্ষণাবেক্ষণ। বছর বছর নতুন অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই উন্নত দেশসহ সর্বত্রই রক্ষণাবেক্ষণে বেশ প্রাধিকার দেওয়া হয়। কোথায় কোন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোনটির পলস্তারা খসে পড়েছে, কোনটাতে মাঝারি পর্যায়ের মেরামত প্রয়োজন্ এবং কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বা বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, তার হাল নাগাদ তথ্য থাকে কর্তৃপক্ষের কাছে। এজন্য আলাদা নিবেদিত তহবিলও থাকে সেসব দেশে, যেন অর্থের অভাবে মেরামত কাজ ব্যাহত না হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হালনাগাদ তথ্য তো দূরের কথা গুরুত্বপূর্ণ মেরামতের জন্যেও প্রয়োজনের সময় বরাদ্দও পাওয়া যায় না। প্রায় ক্ষেত্রেই অর্থ নেই বলে অভিযোগ মেলে।
রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের উত্তম চর্চাগুলো অনুসরণপূর্বক এক্ষেত্রে উন্নতি জরুরি।
আশার কথা, জাইকার সহায়তায় দেশের কোন ক্ষেত্রে কী অবস্থায় আছে তা জানতে ব্রিজ মেইটেন্যান্স সিস্টেম বা বিএমএমএস নামের একটি সফটওয়্যার চালু করে সওজ। এতে কোন সেতু হালকা রক্ষণাবেক্ষণ, কোনগুলো সংস্কার এবং কোনগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হবে সেই সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। একই সঙ্গে একটি মেইটেন্যান্স ম্যানুয়েল তৈরি করার খবর পাওয়া গেছে। এসব বিষয় ইতিবাচক। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা দক্ষতা ও আন্তরিকতায় রক্ষণাবেক্ষণে দেশে অভ্যাসগত দীর্ঘসূত্রতা ও মনোযোগহীনতার অবসান ঘটুক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।