যে কোন জনপদের সামগ্রিক জীবন–আচরণের নামই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি চর্চায় প্রতিটি মানুষের মানসিক ও জাগতিক জীবনের পরিশীলন ঘটে। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তি, কারুশিল্প, হস্তশিল্প ইত্যাদি সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর উৎকর্ষ–পরিপূর্ণতা সাধন না হলে জাতীয় জীবনের পরিপূর্ণ অগ্রগতি সম্ভবপর নয়। সংস্কৃতি বর্জিত, আলোকিত সমাজ হতে পারে না। সেই আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে চট্টগ্রাম বরাবরই অগ্রগামী। তাই এ কথা আজ পরীক্ষিত যে, চট্টগ্রামেই শুরু হয় সবকিছুর; সে আন্দোলন সংগ্রাম হোক আর সংস্কৃতি চর্চা; সৃজনশীলতায় ঊর্বর চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক তৎপরতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখানে হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। গতকাল থেকে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে হাটখোলা ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় তিনদিন ব্যাপী ‘চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক উৎসব ও বইমেলা’র প্রথম দিনে অতিথিবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন। উৎসবের উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। এছাড়া পুরাতন ও সমসাময়িক মুদ্রা, ব্যাংক নোট, ডাক টিকিট ও শখের সামগ্রী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ভাস্কর অলক রায়। সেমিনারের উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তিন দিনব্যাপী এই উৎসব শেষ হবে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর।
সন্ধ্যায় উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি বলেছেন, সংস্কৃতি মানে শুধু নাচ, গান, কবিতা না। সংস্কৃতি মানে জীবনাচরণ। মানুষের সাথে সম্পর্কের খাতিরে আসে নাচ গান, কবিতা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের যে বিজয় অর্জন করেছি সে বিজয় শুধুমাত্র রাজনৈতিক মুক্তির ছিল না। ছিল সাংস্কৃতিক মুক্তিও।
চট্টগ্রাম হাটখোলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রাবন্ধিক কাজী রুনু বিলকিসের সভাপতিত্বে ও বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ, ভারতীয় হাই–কমিশনের সহকারী কমিশনার রাজীব রঞ্জন, কথা প্রকাশের প্রকাশক জসিম উদ্দীন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক উৎসব ও বইমেলা পর্ষদের সদস্য সচিব ও হাটখোলা ফাউন্ডেশনের সম্পাদক কবি ইউসুফ মোহাম্মদ।
সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে জ্ঞান–অর্জনের আহ্বান জানিয়ে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, প্রত্যেক মানুষের উচিত সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানো। উদারভাবে এগিয়ে না আসলে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো না। বই জীবনের পরম বন্ধু, বইকে ছাড়া যাবে না। অনুপ জলোটার কথা উদ্ধৃত করে তিনি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে, অন্যায় আর হিংসা–ক্রোধ থেকে দূরে থেকে ন্যায়ের পথে থাকার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান। এসময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে রিমি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিশাল সময় জেলে কাটিয়েছেন। মাত্র সাড়ে চার মাস বয়সে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখি, বেনেট দেখি, পুলিশ দেখি। বাবা যখন জেল থেকে ছাড়া পান তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বাবাকে যখন মেরে ফেলা হয় তখন আমার বয়স তেরো। কিন্তু তারপরেও আমরা থেমে থাকিনি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে হলে আমাদের বই পড়তে হবে। এসময় তিনি প্রকৃতিকে বাঁচাতে সবাইকে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান। এতে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়ার কথাও তিনি বলেন।
উৎসবে ভারতের রাজস্থানের সংগীত দল “জয়সিলমির বিট”, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংগীত দল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগ, ওডিসি এন্ড ট্যাগর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টারের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছে। শিল্পকলা একাডেমির শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ‘চিটাগাং কালেক্টরস ক্লাব’ এর সদস্যদের সংগৃহীত মধ্যযুগের বাংলার স্বাধীন সুলতানের মুদ্রা, বাংলাদেশের স্মারক মুদ্রা ও ব্যাংক নোট,
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রকাশিত মুদ্রা ও ব্যাংক নোট, নমুনা ব্যাংক নোট, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশিত ডাকটিকিট, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র, বাংলাদেশের বিষয় ভিত্তিক ডাকটিকিট, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট, ব্রিটিশ– ইন্ডিয়ার মুদ্রা ও ব্যাংক নোট, ব্রিটিশ–ইন্ডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক, বেসামরিক ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক মেডেল, ম্যাচ বঙ, পুরাতন দলিল, উপজাতীয়দের ব্যবহৃত অলংকার প্রদর্শন করা হচ্ছে।