বাঙালির শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি এক ও অভিন্ন। দেশে সংস্কৃতি চর্চা দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এ দেশে সংস্কৃতি চর্চা অবাধ ও স্বাধীন ছিল। বাঙালি ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি মুক্ত চিন্তার উর্বর ক্ষেত্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ সামাজিক সংগঠন সাংস্কৃতিক সংগঠন বিশেষ দিবস উপলক্ষে স্ব স্ব উদ্যোগে যাত্রা নাটক মুখ্যাভিনয় কৌতুক ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন বাঙালি সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম অনুসঙ্গ। অতীতে সংস্কৃতি চর্চার যে সকল ক্ষেত্র ছিল বর্তমানে সে সব ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। নির্দিষ্ট কিছু দিবস ও বিশেষ অনুষ্ঠান যা পালন করা হয় তা ও সরকার বা আইন শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অবাধ ও স্বাধীন নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধূলা বই পড়া বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গান কবিতা নাটক নৃত্য দেয়ালিকা ম্যাগাজিন সাময়িকী প্রকাশ পাড়া মহল্লায় গ্রামে সামাজিক সংগঠনে নানা দিবস ও বিশেষ অনুষ্ঠানমালায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য বর্তমানে বিলুপ্ত। এসব অনুষ্ঠানে নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতা ও খেলাধূলায় গ্রামের শিশু কিশোর যুবকদের অংশ গ্রহণে তাদের শরীর মনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য ভূমিকা রাখত। জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ আবাসন সমস্যা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি দখল দূষণ ও যান্ত্রিক জীবনের চাহিদায় খেলার মাঠ খোলা জায়গা এখন কোথাও নেই বললে চলে। যার ফলে শিশু কিশোর যুবকদের মাঠে ময়দানে খেলার পরিবর্তে ঘরে বাসায় ইনডোর বিনোদনে ঝুঁকে পড়েছে। এতে তাদের শরীর মন মননের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আত্মকেন্দ্রিক সামাজিক সমপ্রীতি বিচ্ছিন্ন হতাশা মানসিক চাপ উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ ধর্মান্ধ নিষ্ঠুরতা সমাজ কে গ্রাস করছে। সুষ্ঠু ও সঠিক সংস্কৃতি চর্চার অভাবে যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দায়সারা ভাবে কিছু দিবস ও অনুষ্ঠান উদযাপন দায়িত্ব শেষ করলে দেশে সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটছে ঘটবে এমন ভাববার অবকাশ নেই। সুস্থ সংস্কৃতি ও বিনোদনের হারানো অতীত ফিরিয়ে আনতে বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন। টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে পড়ালেখার অত্যধিক চাপে শিক্ষার্থীরা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ দিতে হবে যাতে পরস্পরের যোগাযোগ সৃষ্টিশীল প্রাণবন্ত সুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশ গড়ে উঠে। সংস্কৃতি চর্চা সংকুচিত হওয়ার জন্য রাজনীতিও কম দায়ী নয়। সবক্ষেত্রে দলীয়করণের ফলে দক্ষ যোগ্য অভিজ্ঞ নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অবাধ নিরপেক্ষ স্বাধীন সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ না থাকায় রাজনীতির প্রভাবে অনেক সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি দূরে সরে রয়েছে বা দূরে রাখা হয়েছে যা সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার প্রধান অন্তরায়। সংস্কৃতি জাগরণের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে এর বিকাশ ও বাধা অপসারণ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গুরু দায়িত্ব। যে সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে আন্দোলিত করে, নানা অজুহাতে তার নিয়ন্ত্রণ করে সে পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় অল্প পরিসরে যেটুকু চালু আছে তা শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বান্ধব সমাজ গঠনে যথেষ্ট নয়। সমাজে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ উগ্রবাদ প্রতিহত করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। সংস্কৃতি মানুষকে অপসংস্কৃতি ও হতাশা থেকে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগায়। সুস্থ সংস্কৃতি মানুষকে আলোকিত করে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলেও এখন শহর নগর গ্রামে কিছু সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমী শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম নিজেদের শক্তি সামর্থ্য ও সাংগঠনিক মেধায় অনেক প্রতিকূল অবস্থায় সাহিত্য সংস্কৃতি মূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। গ্রামের বিলুপ্ত প্রায় সামাজিক সংগঠনগুলোকে সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ও পৃষ্ঠপোষকতা উৎসাহ প্রদান করলে যুব সমাজ সামাজিক কর্মকাণ্ডে সমাজ সেবা ও কল্যাণে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হবে এতে সন্দেহ নেই। সুস্থ সুন্দর ও মানবিক সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে সুস্থ বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। খোলামেলা পরিবেশে সংস্কৃতির সুস্থ ধারা বহমান থাকলে বিরাজিত অস্থির সমাজ সুস্থ থাকবে। দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে একটি কাঠামোয় এনে তাদের কর্মকাণ্ড গতিশীল করা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। গ্রামের জারিগান, পালাগান, পুঁথিপাঠ, কীর্তন, কবিগান, লালনগীতি বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে নির্বাসিত। প্রযুক্তির অপব্যবহার সুস্থ বিনোদনের অভাব কিশোর অপরাধ বেড়ে চলেছে এ অবক্ষয় শুধু আইন দিয়ে দমন করা সম্ভব নয়। সংস্কৃতি আরোপিত কোনো বিষয় নয় সুস্থ সংস্কৃতির প্রচলিত আবহকে সৃজনশীল রূপান্তরের মাধ্যমে এর প্রয়োগ শিশু কিশোর তথা যুব সমাজের ক্ষয়িষ্ণু অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে শিক্ষার সাথে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সমন্বয় করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক