সংস্কারকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি করা হচ্ছে। যা শেষ হয়ে যায় তা সংস্কার নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল শুক্রবার বিকালে বিএনপির ইফতার আয়োজনে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে সংস্কার এবং নির্বাচনকে দৃশ্যত যেভাবে মুখোমুখি করে ফেলা হয়েছে এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক।
তারেক রহমান বলেন, যারা সংস্কার শেষ করার পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে কথা বলছেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, যেটি শেষ হয়ে যায় সেটি সংস্কার নয়। কারণ সংস্কার কখনো শেষ হয় না। সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকারের সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপি বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা নতুন সংবিধান রচনা করতে চায়।
তারেক রহমান বলেন, দেশের বর্তমান সংবিধান যেটিকে ইচ্ছামতন কাটাছেঁড়া করে পতিত পলাতক স্বৈরাচার প্রায় তাদের দলীয় সংবিধানে পরিণত করে ফেলেছিল, সেই সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের দুই নম্বর দফায় লেখা রয়েছে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকার পরেও পলাতক ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, সারা বিশ্ব দেখেছে বার বার জনগণের ভোট ছাড়াই গঠন করা হয়েছিল জাতীয় সংসদ। পলাতক স্বৈরাচার সংবিধান মানেনি। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, এই কারণে বিএনপি মনে করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কেতাবি কিংবা পূঁথিগত সংস্কার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং আচরণের ব্যবহারিক প্রয়োগ। জনগণের গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে কেবল সংস্কার টেকসই, সফল এবং কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকার ইস্কাটনে লেডিস ক্লাবে বিএনপি বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সম্মানে এই ইফতারের আয়োজন করে। সেখানে আলোচনা পর্বে তারেক রহমান বলেন, দেশের বিশিষ্ট নাগরিক তথা সুশীল সমাজ এবং পেশাজীবীদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র এবং রাজনীতির ভালো–মন্দের অনেক কিছুই নির্ভর করে রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির ওপর। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজে বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের ভূমিকা যত বেশি কার্যকর থাকে রাজনৈতিক সরকারও তত বেশি দায়িত্বশীল এবং শক্তিশালী হয়।
পতিতরা যেন ফেরার সুযোগ না পায় : বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সরব হওয়ার মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার দাবি তুলেছিল বৈষম্যরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই দাবি প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিরোধিতা করে তারেক রহমান বলেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গৌণ ইস্যুকে মুখ্য ইস্যু বানাতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যের মধ্যে সংশয়–সন্দেহের জন্ম দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। আমি অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবারও বলতে চাই, সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না যাতে রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পায়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দীর্ঘ দেড় দশকের মাফিয়া শাসনকালে তরুণ প্রজন্মের প্রায় সাড়ে তিন কোটি ভোটারসহ কেউ ভোট দিতে পারেনি। এসব ভোটারদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্যে সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। নাগরিকরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী না হলে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এখন আমরা কঠিন সময় পার করছি : গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সাত মাস হয়ে গেলও সংস্কার, নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার বিষয়ে নানা ধরনের দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আজকে একটা অত্যন্ত কঠিন সময় অতিক্রম করছি। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিতাড়িত করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে এবং নতুন একটা গণতান্ত্রিক সংসদ ও সরকার গঠিত হবে সেই প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, আমরা যারা রাজনীতি করছি তারা, আমরা যারা বিভিন্ন পেশায় আছি তারা, যারা বিভিন্নভাবে সরকার অথবা জনগণের সাথে সম্পৃক্ত আাছি তারা সবাই এমনভাবে কথা বলব, কাজ করব তা যেন গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে সুগম করে দেয়। ফখরুল বলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, সেই কারণে আমরা প্রায় দুই বছর আগে আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব সংস্কারের জন্যে ৩১ দফা কর্মসূচি জাতির কাছে দিয়েছেন। সেই কর্মসূচির মধ্যে আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে কথাগুলো বলা আছে, সেগুলো আমরা মনে করি দেশের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও খাপ খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।
সংকট উত্তরণে দ্রুত নির্বাচন দরকার : মির্জা ফখরুল বলেন, এখন সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান দরকার। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় যে সংস্কার দরকার সেগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই হবে সবচেয়ে বড় উইজডমের কাজ। এখন সেই উইজডমের কাজটা করাই বোধহয় সবচেয়ে ভালো হবে। উগ্রবাদ আলামত দেখা যাচ্ছে মন্তব্য করেন তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো উগ্রবাদ আমাদের গণতান্ত্রিক পথকে সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত করবে। আমরা যেন সেই পথে কোনো মতেই এগিয়ে না যাই।
ইফতারে আয়োজন বক্তব্য রাখেন– সাংবাদিক শফিক রেহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম ফায়েজ, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদীন, ব্যবসায়ী সালাহ উদ্দিন আলমগীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন, যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম এ আজিজ ও সৈয়দ আবদাল আহমেদ।
ইফতারে অংশ নেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক, উলামা–মাশায়েখ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, কৃষিবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুস সালাম পিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ এম আবদুল হালিম, ইসমাইল জবিউল্লাহ।