ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সংস্কার বিষয়ে সবার মধ্যে ঐকমত্যের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেছেন, সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত জাতীয় সংলাপে গতকাল শুক্রবার ভার্চুয়ালি যোগ দেন ইউনূস। খবর বিডিনিউজের।
‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ স্লোগানের ওই সংলাপে রাখা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই তিন লক্ষ্যের কোনোটিকে ছাড়া কোনোটি সফল হতে পারবে না। ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ মূলত নির্বাচন কমিশনের। নাগরিকদের নির্বাচনের তারিখ না পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সময় দিতে হয় না। সংস্কারের কাজে দেশের প্রতিটি নাগরিককে অংশগ্রহণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইউনূস। তিনি বলেন, যারা ভোটার তারা তো অংশগ্রহণ করবেনই, তার সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে ভোটার হবেন তারাও সর্বাত্মকভাবে সংস্কারের কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করুন। জানুয়ারির মধ্যে ছয়টি বড় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পাবেন বলে আশা করছেন ইউনূস। তিনি বলেন, প্রত্যেক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব হলো প্রধান বিকল্পগুলো চিহ্নিত করে তার মধ্য থেকে একটি বিকল্পকে জাতির জন্য সুপারিশ করা। যার যার ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কীভাবে রচিত হবে, তা বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে সুপারিশমালা তৈরি করে দেওয়া, নাগরিকদের পক্ষে মতামত স্থির করা সহজ করে দেওয়া।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করলেই আমাকে–আপনাকে তা মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এ জন্য সর্বশেষ পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
ভোটারের বয়স ১৭ বছর হওয়া উচিত : ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার করার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, কোন বয়সে একজন নাগরিক ভোটার হতে পারবে তার জন্য নানা দেশে নানা বয়স নির্ধারণ করা আছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশন নিশ্চয়ই এ রকম একটা বয়স সুপারিশ করবে। সে বয়স আমার পছন্দ হতেও পারে নাও হতে পারে। ধরুন আমি তরুণদের তাড়াতাড়ি ভোটার করার পক্ষে। যে যত তরুণ, পরিবর্তনের প্রতি তার আগ্রহ তত বেশি, এই হলো আমার যুক্তি। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেবার জন্য আমি মনে করি ভোটার হবার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন কী সুপারিশ করবেন, তা আমার জানা নেই। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি কমিশনের সুপারিশ করা বয়স পছন্দ করে, ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য আমি তা মেনে নেব।
সব কমিশন বহু সুপারিশ তুলে ধরবে জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে, যার যাই মতামত হোক না কেন আমরা দ্রুত একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করে সংস্কারের কাজগুলো করে ফেলতে চাই। নির্বাচনের পথে যেন এগিয়ে যেতে পারি, সেই ব্যবস্থা করতে চাই।
অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে : জুলাই গণঅভ্যুত্থান হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে ইউনূস বলেন, আমাদের ছাত্র–জনতা অটুট সাহসে শিশু হত্যাকারী ও পৈশাচিক ঘাতকদের মোকাবিলা করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে এমন নিষ্ঠুরতাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জুলাই গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নকে সাহসী করে তুলেছে। বাকহীন বাংলাদেশ জোরালো কণ্ঠে আবার কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়েছে। এই দৃঢ় কণ্ঠ আবার ঐক্য গঠনে সোচ্চার হয়েছে।
ঐক্যই মূল শক্তি মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ঐতিহাসিক মাত্রায় বলীয়ান করেছে। গত পাঁচ মাসে এই ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধ শক্তি আমাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করার ক্রমাগত প্রয়াস চালাতে থাকায় আমাদের ঐক্য আরও মজবুত হচ্ছে।
সব নাগরিকের জন্য সম্পদের ও সুযোগের বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে এমন অর্থনীতি গড়ে তোলার কথাও বলেছেন ইউনূস। এমন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ থাকবে যেখানে সংখ্যালঘু–সংখ্যাগুরু এই পরিচিতি অবান্তর হয়ে পড়বে। সবার একটিই পরিচয়, আমি বাংলাদেশের নাগরিক এবং রাষ্ট্র আমাকে আমার সব অধিকার প্রদান করতে বাধ্য। রাষ্ট্রের কাছে এবং অন্য নাগরিকের কাছে আমার অন্য কোনো পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। যেখানে ব্যক্তি বন্দনার কোনো সুযোগ থাকবে না। দেশের ভেতরে বা বাইরে প্রভু–ভৃত্যের কোনো সম্পর্কের সুযোগ থাকবে না।