অনাদিকাল থেকেই সংগীত বিশ্বে বিরাজিত আছে। ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, রাজসিকতা ও তামসিকতা থেকে সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন ও সাধারণ সমাজের কল্যাণে সংগীতের উদ্ভব। অনেকে মনে করেন মানুষের ভাষা সৃষ্টির আগেই সংগীতের উদ্ভব হয়েছে।
তাত্ত্বিকরা বলেন, নাদ থেকেই সংগীতের উৎপত্তি। সংগীত জীবের স্বভাবধর্ম, এই স্বভাবধর্মেই নিহিত আছে সংগীতের ইতিহাস, উদ্ভাস ও প্রকাশ। ভাষা সৃষ্টির আগে এই নিরক্ষর পৃথিবীতে প্রাণীজ কণ্ঠস্বরের মনোহর ধ্বনিই মানবীয় চর্চা ও অনুকরণ দ্বারা উৎকর্ষতা প্রাপ্ত হয়ে সংগীতে পরিণত হয়েছে। তখন সমাজ ছিল শ্রেণিবিহীন, একে বলে অযাচার বা আদিম সাম্যবাদী সমাজ, যা ছিল পরিপূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর ও প্রতিষ্ঠান বিহীন।
‘সমাজ‘ বলতে আমরা সেই ব্যবস্থাকেই বুঝি যেখানে একাধিক চরিত্র বা ব্যক্তি, একদল লোক বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ কিছু নিয়ম কানুন সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থার অধীনে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে, নিজেদের প্রয়োজন ও নিরাপত্তার বিধানের কারণে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশ ও আবহ সৃষ্টি করে একত্রে বসবাস করে। যেখানে যাবতীয় দলের নানা সংস্কার, রীতিনীতি, নিয়ম কানুন, পণ্যের আদান প্রদান বিদ্যমান।
আবার, সমাজতত্ত্ব হল সামাজিক জীবন সম্পর্কিত জ্ঞান বা সমষ্টিগত আচরণের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার বিজ্ঞান বা সেই বিজ্ঞান যা সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সমাজকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পাঠ করে, সমাজকে পর্যবক্ষেণ, অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করে, আধুনিক সমাজের মানবগোষ্ঠী ও তাদের সামাজিক জীবনের নিয়মভিত্তিক চর্চা করে, সমাজের পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করে এবং একে অপরকে সম্পর্কিত করে তার ব্যাখ্যা দেয়, সামাজিক সংগঠন ও সমাজ পরিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যা করে, মানব সম্পর্ক অধ্যয়ন, মানব গোষ্ঠী বা সমষ্টিগত আচরণের বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা করে। সর্বোপরি সমাজতত্ত্ব হল সে বিজ্ঞান যা সমাজের গঠনপ্রণালী এবং পরিবর্তনশীল সমাজকাঠামোকে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে। মানুষের আচার, আচরণ, অভ্যাস, রীতিনীতি, প্রথা বা সামগ্রীক জীবন প্রণালী অধ্যয়ন করে।
সমাজ বিজ্ঞানী হার্ভার্ড স্পেন্সার, এমিল ডুর্খাইম ও সংগীতের সমাজতত্ত্বের পুরোধাপুরুষ ম্যাঙ ওয়েবার এর মতে, ‘সমাজতত্ত্ব হল সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনের সামাজিক দিক ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লষণ ও আচরণের বিজ্ঞান। ’
সমাজতত্ব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ধর্ম, মানুষ, মানুষের সংস্কৃতি, তাদের মিথস্ক্রিয়া, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, মানব সম্পর্ক যা আধুনিকতা, নগরায়ন, ঔপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে।
ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক শ্রেণি, অঞ্চল–স্বকীয়তায় তার বাকভঙ্গি সুররূপে সৃজিত হয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রেক্ষিতে। সমাজের আত্মীকরণে আদান–প্রদান, বিস্তার, বিবর্তনে তার শিল্পরূপ লাভ সম্ভব হয়েছে, যা একক ভাববিলাসে বা গোষ্ঠীগত আচার, সংস্কার, বিশ্বাসে, চাওয়া পাওয়ায় রঞ্জিত হয়েছে সময়ের হাত ধরে। সমাজ থেকেই সংগীত ঐতিহ্যের উত্থান, বিকাশ ও ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রবহমানতায় ক্রিয়াশীল। যুগ প্রগতির সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি আসার ফলে সমাজে সংগীতের পটভূমিতে এসেছে পরিবর্তন। নৌকা থেকে জাহাজ, উড়োজাহাজ, স্টীমার, রেলগাড়ি প্রভৃতি স্থল ও জলযান, আইন আদালত ব্যবস্থায় ব্যবহৃত বহু আরবী, ফারসী, ইংরেজী শব্দের অনুপ্রবেশে প্রকটিত হয়েছে গানে আধার। সমাজমনস্কতা থেকে এর বিপুল বিস্তার যেমন ঘটেছে, তেমনি মানুষের আধ্যাত্মবোধ সঞ্জাত গানের ধারাটিও বিকাশ লাভ করেছে সঙ্গে সঙ্গে।
আবহমান গ্রামীণ খেলাধূলা, কৃষিকাজে, হস্তশিল্পের কাজে, মাছ ধরার শ্রমের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামী প্রয়াস নানা গীত, নৃত্য, শিল্প সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ সুনিশ্চিত করেছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীনতম সভ্য দেশের সংগীত সেই সব দেশেরই আদিম নাচ, গান, বাজনার ক্রমবিবর্তিত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আদিম সমাজে মানুষ ছিল সভ্যতা– পূর্ববর্তী সময়ের মানুষের পাশবিক অবস্থায়, যেখান থেকে তারা ধীরে ধীরে সভ্যতার দিকে এগিয়ে উন্নীত হয় সভ্যতার আদি অবস্থায়।
সমাজের সূচনাতে গান প্রয়োগের ক্ষেত্র ছিল দু‘ ধরনের–ধর্মীয় এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বা সামাজিক। মানুষ্য সমাজের অস্তিত্বরক্ষা, প্রকৃতির রোষ থেকে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত মুক্তি ও মঙ্গলসাধনের জন্য আদিম মানুষেরা বিবিধ উৎসর্গ অনুষ্ঠানের দ্বারা প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করত। এই সকল পবিত্র অনুষ্ঠান থেকেই নাচ গানের উৎপত্তি।
সংগীত যে মানুষ্যসমাজের আদিমতম অবস্থা থেকে ক্রমবিবর্তনের সাথে, তার কর্ম পদ্ধতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত তা সমাজতত্ত্বিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যায়, শিকারী, গোপালক, জুমখেতি লাঙলখেতি করা আদিম নৃগোষ্ঠীর যূথবদ্ধ কর্মজীবন থেকে সব স্বর, সুর, ছন্দ, লয়ের উৎপত্তি।
‘ইলিউশন এন্ড রিয়ালিটি‘ গ্রন্থে কড্ওয়েল বলেছেন– ‘কাব্য হল মানব মনের প্রাচীনতম নান্দনিক সক্রিয়তার অন্যতম।
সংগীত ও কাব্য উভয়েই সমকালে জাত এবং আদিম মানুষেরা অঙ্গভঙ্গী, লম্ফঝম্প, চিৎকারের শব্দ ও অর্থহীন শব্দ, লাঠি ও পাথরের আঘাতে কৃত্রিম আওয়াজ সৃষ্টি ইত্যাদির মধ্যে যে জৈব ছন্দ তা নৃত্য, কাব্য ও সংগীতের জনক। ’
কড্ওয়েল আরো বলেছেন ‘আদিম খাদ্যসংগ্রহকারী বা শিকারজীবী মানুষ প্রকৃতির মধ্যে তার নিজস্ব অভিপ্রায় সন্ধানের কল্পনা করে। সে প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে নিজেকে সামাজিকভাবে পরিবর্তন করে। তাই তার শিল্প স্বাভাবিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। শস্য উৎপাদনকারী এবং পশুপালনকারী গোষ্ঠীর মানুষেরা আরও এগিয়ে। তারা প্রকৃতিকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে এবং ঘরোয়া চাষ ও পশুকে পোষ মানিয়ে তাদের ইচ্ছানুযায়ী প্রকৃতিকে বদলায় এবং তার শিল্প সংস্কৃতি হল প্রথানুযায়ী।
আদিম সমাজ ছিল সমষ্টিগত শ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত, আর আদিম অসভ্য মানুষই কাজের মানুষ। যুগে যুগে কাব্য আর সংগীতের কোনও পার্থক্য ছিলো না। তখন কাব্য বা সংগীত ছিল সর্বক্ষেত্রে কায়িকভঙ্গী ও যন্ত্রসংগীতের সংগে জড়িত। নৃত্য, সংগীত ও কাব্য একই জন্মসূত্রে আবদ্ধ।
আদিম সাংস্কৃতিতে সংগীত অঙ্গীভূত হয়েছিল বরাবরই –আচারানুষ্ঠান, বিধিনিষেধের মধ্যেও বর্বর মানুষ এই সংগীতেই প্রশান্তি খুঁজে পেত। অবসরে, কর্মে, শিকারে, মাছ ধরায়, যুদ্ধকালীন সময়ে, প্রেমের মুহূর্তে, বৃষ্টি ও মৃত্যুর ছায়াপাতে। আদিম গানের প্রকৃতি ছিল সরল, এক ঘেয়ে, অবরোহী গতিক। এই সকল সামাজিক গান থেকে জন্ম নিল লৌকিক গান। লৌকিক গান থেকেই জন্ম নিয়েছিল পরবর্তী কালে বিচিত্র পল্লী গান বা লোকগান। অনেকে বলেন একে ‘দেশীগান‘। এখান থেকেই জন্ম নেয় দেশী বা আঞ্চলিক গান এবং অন্যগুলি হয় পল্লী গান।
আদিম সামাজিক জীবনে ছিল বিভিন্ন ধরনের নাচ আর গান, প্রত্যেকটির ছিল পৃথক ব্যবহার– যুদ্ধ, শিকার, শস্য বপন, শস্য কাটা, ঘুম পাড়ানোর আর ভালোবাসার। সামাজিক ক্রিয়াকলাপের জন্য এ রকম সব নির্দিষ্ট সাংগীতিক ধাঁচ থেকেই দেখা দিয়েছে নানান সামাজিক রূপকল্প। আদিম সামাজিক সাংস্কৃতির একটা দিক হল নানা প্রকার আকর্ষণীয় আঙ্গীক সৃষ্টির পাশাপাশি গান, নাচ, যুদ্ধযাত্রা, শ্রমসাধ্য কাজ এবং প্রাত্যহিক জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংগীত কে কাজে লাগাতো তারা। আদিম জীবনে সংগীতের মূল ধারাটি সময়ের ব্যবধানে রূপে, রসে, সৌন্দর্যে, সৌষ্ঠবে সংগীতোপযোগী শিল্পে উন্নীত হতে পেরেছে। সংগীতের বিকাশ সর্বদাই সামাজিক। আদিম জীবনে গান ছিল এক সুরেলা আলাপ, সামপ্রদায়িক ঐক্য ও সমপ্রীতির আবেদন। আমরা তাই আদিম শিকারী সমাজ, খাদ্য আহরণকারী সমাজ, পশু পালনকারী সমাজ, কৃষিভিত্তিক সমাজ, শিল্প নির্ভর সমাজ বা অন্যভাবে সমাজ পরিবর্তন ও বিবর্তনের অনিবার্য ধারায় আদিম সাম্যবাদ, দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায়, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ও সাম্যবাদী সমাজে ধর্ম, বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গের সামাজিক বাস্তবতা থেকে প্রতিটি গান রচিত, উত্থিত ও প্রসারিত।
সংগীত সৃষ্টি ও সম্পাদন একটি দলীয় তথা সামাজিক ব্যাপার। শুরু থেকেই সংগীতের দলীয় অভিব্যক্তি–আয়োজন সংগীতের সামাজিকতাকেই প্রকাশ করে। সামাজিক ক্রিয়া হিসেবে সংগীতের সৃষ্টি ও শ্রবণ সতত মতৈক্যের ও পুনর্গঠনের বিষয়বস্তু হয়ে গেছে। যেহেতু সংগীতের সমাজতত্ত্ব এখনো সব মহলে সুবিদিত নয় তাই সংগীতের মত একটি বহুমুখী মানবীয় শাখার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরি।
সভ্যতার ক্রমবিবর্তন সংগীত চর্চার ইতিহাস নিঃসন্দেহে দীর্ঘ ও বিচিত্র। সংগীতের প্রতিটি ব্যঞ্জনা এমন একটি উৎকর্ষ মাত্রা লাভ করে যা সাধারণ যৌক্তিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সংগীত হল যোগাযোগের মাধ্যম। যার সঙ্গে সমাজ ও ব্যক্তির আবেগ জড়িত থাকে। মানুষ কীভাবে সামাজিক উদগাতা হিসাবে সাংগীতিক গুণাবলি ধারণ করল, কীভাবে সংগীত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মকাণ্ড– হিসেবে স্বীকৃত হলো এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমন্বয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগীতের আয়োজন দেখা যায়, তা জানা প্রয়োজন। সংগীতের সামাজিক সম্পাদন ও গ্রহণ আবার সংগীতকে আরো সংহত ও সুচারু করে। সংগীতকার ও সংগীতের ওপর সমাজ, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, নগরায়ণ, নরগোষ্ঠী, সুসংগঠন ও সমপ্রদায়গত কাঠামোর প্রভাব অপরিসীম।
সংগীতের সমাজতত্ত্ব তাই সমাজ পরিসরে সংগীতের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাবের দিকটি গভীরভাবে জানতে চায়। সংগীতের সমাজতত্ত্ব দেখতে চায় সমাজের উৎসমুখগুলো কীভাবে সংগীত সৃষ্টি, অনুশীলন ও সম্পাদনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সংগীতের সমাজতত্ত্ব দেখতে চায় সমাজের উৎসগুলো, কীভাবে সংগীত সৃষ্টি হল এবং তা অনুশীলন ও সম্পাদনের ক্ষেত্রে সমাজে কী কী ভূমিকা রাখে। সংগীত সৃষ্টি ও সম্পাদন একটি দলীয় তথা সামাজিক ব্যাপার। শুরু থেকেই সংগীতের দলীয় অভিব্যক্তি–আয়োজন সংগীতের সামাজিকতাকেই প্রকাশ করে। সামাজিক ক্রিয়া হিসেবে সংগীতের সৃষ্টি ও শ্রবণ সতত মতৈক্যের ও পুনর্গঠনের বিষয়বস্তু রয়ে গেছে। সংগীতের মধ্যে সমাজ– অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সংগীত শিল্পী, প্রাবন্ধিক