সংগীত হল ছন্দ ও স্বরগ্রামের সাহায্যে গঠিত এক ধ্বনি শিল্প, মানুষের স্বরশ্রুতি আর নৈপুণ্যের ফসল। সংগীত মূলগতভাবেই মানুষের আবেগজাত ক্রিয়াকলাপ, মানুষের আবেগরাশিকে বহিরাশ্রয় দেয়ার একটা পন্থা। এর কেন্দ্রে থাকে সৌন্দর্যের অনুভূতি, এই অনুভূতিই হল আনন্দ, সংগে থাকে জ্ঞান, মানুষে মানুষে এক সাধারণ বন্ধনের স্বীকৃতি। সংগীত হল ধ্বনিতে ধৃত মানবিক রূপকল্প, কণ্ঠস্বর, আংগুল আর শরীরের সাহায্যে নৈপুণ্যতার সম্পাদনরীতি। আদিকাল থেকে মানব জাতির অংগভংগী, লম্ফঝম্প, চিৎকারের শব্দ ও অর্থহীন শব্দ, লাঠি ও পাথরের আঘাতে কৃত্রিম আওয়াজের সৃষ্টি ইত্যাদির মধ্যে যে জৈব ছন্দ তা নৃত্য, কাব্য ও সংগীতের জনক। নৃত্য, কাব্য ও সংগীত একই জন্মসূত্রে আবদ্ধ।
সংগীতের উদ্ভব, উৎপত্তি বা বিকাশ কখন কীভাবে হয়েছে সে বিষয় নিয়ে তাবৎ বিশ্বের সংগীতজ্ঞ, সংগীত বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং সংগীতবিদদের মধ্যে গবেষণা, বিশ্লষণ, চিন্তা ভাবনা বা জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই।
কারো কারো মতে শিশুর কান্না থেকে মানুষ সুর পেয়েছে, কেউ বলছেন পশুপাখির কলরব বা ধ্বনি থেকে সংগীতের উদ্ভব বা উৎপত্তি। আবার কেউ বলছেন সমুদ্রের তরংগের গর্জন, বাতাসের মর্মর ধ্বনি, নদীর কলতান, ঝর্ণার কুল কুল ধ্বনি, বৃষ্টির রিম ঝিম শব্দের মধ্যে বা প্রকৃতির মাঝ থেকেই মানুষ খুঁজে পেয়েছে সংগীতের সুর। সংগীতের উৎস যে ধ্বনি তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ রইল না।
সিগমুন্ডফ্রয়েড, হারবার্ট স্পেনসার, জ্যাঁ জ্যাক রুশো প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকেরা বলেছেন লোকসমাজে মানুষের কথা বলা, ভাব বিনিময়ে স্বরের উত্থান পতনের মধ্যে, হৃদয়াবেগের অভিব্যক্তির মধ্যে সুরের রেশ মিশে থাকে।
মনোবিজ্ঞানী ইয়ুভ বলেছেন, মানুষের ভয়, দুঃখ, ক্রোধ, ভালোবাসা, হর্ষ প্রভৃতি মানসিক বৃত্তি উদ্বেলিত হওয়ার ফলে যে আবেগ ও অনুভূতি তাদের মনে সৃষ্টি হয় সেই ভাবাবেগের প্রকাশ থেকেই সংগীতের উদ্ভব। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের মতে আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী মনীষীরাও বলেছেন, পশুপাখিদের অনুকরণে মানুষেরা নিরর্থক ভাষায় একসময় ঈশ্বরের বন্দনা সংগীত গাইতে শুরু করেছিল। তাই এটা মনে করা যুক্তিযুক্ত যে সংগীতের আদি উৎস ধ্বনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংগীতের সুরের প্রেরণ্ ধ্বনি থেকে পেলেও সকল ধ্বনি সংগীতের উপযোগী না। ধ্বনি যখন সূক্ষ্ম পদার্থে আঘাত করে তখন সৃষ্টি হয় ‘নাদ‘ এর। সংগীতের মূল ভিত্তি কিন্তু এই ‘নাদ‘। অনেকে বলেন, আকাশে মেঘ ও বায়ুর ঘর্ষণে যে ধ্বনির সৃষ্টি হয় সেটিই ‘নাদ‘।
‘নাদ‘ এর আক্ষরিক অর্থ বিচার করলে দেখা যাবে যে ‘ন‘ কার শব্দের অর্থ প্রাণিবাচক এবং ‘দ‘ কার শব্দের অর্থ অগ্নিবাচক। মূল কথা বায়ু এবং অগ্নি যোগ করে যে ধ্বনি সৃষ্টি হয় সেটিই ‘নাদ‘।
‘সংগীত পরিজাত‘ এর লেখক শ্রী শচীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছেন,’ আমাদের হৃদয়স্থিত অনাহত চক্রে যখন বায়ু ও অগ্নির সংযোগ বা সংঘর্ষ ঘটে, তখনই নাদ এর উৎপত্তি হয়। পার্শদেব বলেছেন, প্রাণবায়ু নাভিতে আহত হয়ে নাদ সৃষ্টি করে ।
শ্রী সূধাংশু কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতে, নাভিমূল থেকে বায়ুর সাহায্যে উত্থিত ধ্বনিই নাদ। নাদ বা শব্দ প্রকৃতপক্ষে এক।
এই নাদের কম্পন থেকেই স্বরের সৃষ্টি। মানুষের কণ্ঠ থেকে উত্থিত হওয়া নাদই স্বর।
আদিযুগের সংগীতবিদগন পশুপাখির কণ্ঠের শব্দগুণ লক্ষ করে সাতটি সাংগীতিক স্বরের সৃষ্টি করেন।
এই সাতটি স্বরের নামকরণ করেন–
ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ।
যাদের আদ্যাক্ষরের ভিত্তিতে বলা হয় সা রে গা মা পা ধা নি।
এই সাতটি স্বর মধ্যে ‘সা‘ নেয়া হয়েছে ময়ূরের কণ্ঠ থেকে, ‘রে‘ নেয়া হয়েছে গাভী বা বৃষভ থেকে, ‘গা‘ হচ্ছে ছাগ থেকে, ‘মা‘ নেয়া হয়েছে ক্রৌন্চ বা বকের কণ্ঠ থেকে, ‘পা‘ নেয়া হয়েছে কোকিলের কণ্ঠ থেকে, ‘ধা‘ হচ্ছে অশ্ব থেকে আর ‘নি‘ নেয়া হয়েছে হস্তীর কণ্ঠ থেকে।
সংগীত শিক্ষার শুরুতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সা রে গা মা পা ধা নি এই সাতটি বর্ণের সাহায্য কণ্ঠ সাধন করতে হয়। এই বর্ণগুলিকে বলা হয় স্বর। সংগীত– জ্ঞানীরা তাই ধ্বনি থেকে নাদ এবং নাদ থেকে শ্রুতি বেছে নিয়ে তাদের নাম দিয়েছেন স্বর।
স্বর দুই প্রকার প্রকৃত বা শুদ্ধ স্বর ও বিকৃত স্বর। প্রকৃত বা শুদ্ধ স্বর মোট সাতটি। আর বিকৃত স্বর পাঁচটি। প্রকৃত বা শুদ্ধ সাতটি স্বরের মধ্যে থেকে সা ও পা বাদে বাকি স্বরগুলির রূপান্তরের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে বিকৃত স্বর। অর্থাৎ রে গা মা ধা ও নি এই পাঁচটি স্বরই প্রকৃত ও বিকৃত এই দুই রূপের হয়ে থাকে।
প্রকৃত বা শুদ্ধ ও বিকৃত স্বরের আবার দুটি করে রূপ আছে। তারা চল স্বর ও অচল স্বর। আর বিকৃত স্বরের দুটি রূপ হল কোমল ও কড়ি বা তীব্র স্বর।
প্রকৃত বা শুদ্ধ স্বরগুলির মধ্যে সা ও পা কখনো বিকৃত হয় না। তাই এ দুটি স্বর কে বলে অচল স্বর। আর সা ও পা বাদ দিয়ে বাকী পাঁচটি স্বর রে গা ধা মা নি হল চল স্বর। কারণ এগুলোর বিকৃতি ঘটে।
বিকৃত পাঁচটি স্বরের মধ্যে যে দুটি রূপ আগে উল্লেখ করেছি তার মধ্যে রে গা ধা ও নি এই চারটি স্বরের কোমল রূপ হয় আর মা স্বরটির হয় শুধু তীব্র বা কড়ি রূপ।
ইলা মজুমদারের অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত বই ‘সংগীতের তত্ত্বকথা‘ পৃঃ১৩ তে উল্লেখ আছে, ‘সপ্ত স্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে আরব দেশে দু একটি কাহিনীর উল্লেখ করা যায় যা প্রবাদবাক্যরূপে প্রচলিত আছে। যেমন–আরব দেশ প্রচলিত একটি কাহিনী থেকে জানা যায় যে, হযরত মুছা (রাঃ) একদিন পাহাড়ে শিকারে গেলে একটি দৈববাণী শুনতে পান, ‘হযরত মুসা তোমার তলোয়ার দিয়ে সামনের পাথরে আঘাত কর‘। সেই বাণী অনুসারে পাথরে আঘাত করলে তা খণ্ড হয়ে যায় এবং সেগুলো থেকে সাতটি জলধারা নেমে আসে। সেই সাতটি জলধারা থেকেই নাকি সংগীতের সাত স্বরের উৎপত্তি।
আর একটি প্রচলিত কাহিনী আছে যে আরবদেশে ‘মুসিকার‘ নামের সাতটি ছিদ্রযুক্ত লম্বা নাকওয়ালা এক ধরনের পাখী ছিল, যার ধ্বনি থেকেই নাকি সাত স্বরের উৎপত্তি‘।
স্বর এর আলোচনায় প্রায় সব বিশেষজ্ঞরাই মনে করেন নাভিমূলই স্বর সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু।
নাভিমূল থেকে সৃষ্ট স্বর নাসা, কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু ও দন্ত
– এই ছয় স্থান থেকে উৎপন্ন বলে এই স্বরটির নাম ‘ষড়জ ‘ বা ‘সা‘।
নাভি থেকে উৎপন্ন হয়ে যে স্বর বায়ুর সাহায্যে নিম্নাভিমুখী হয় এবং পরে কণ্ঠ ও মস্তিষ্কে আহত হয়ে বৃষের মত ধ্বনি সৃষ্টি করে, তাকে ‘ঋষভ‘ বা রে বলে।
যে স্বর নাভি থেকে উৎপন্ন বায়ুর সাহায্যে কণ্ঠ ও শিরে আশ্রয় নেয় এবং স্বরান্তর সমূহের গন্ধযুক্ত স্বর হিসেবে নিঃসৃত হয় তাকে ‘গান্ধার‘ বা গা বলে।
নাভি থেকে উৎপন্ন যে স্বর কণ্ঠ স্পর্শ করে বক্ষে অবস্থান করে ধ্বনি সৃষ্টি করে, তাকে আমরা ‘মধ্যম’ বলে জানি।
নাভি থেকে উৎপন্ন বায়ু কণ্ঠ ওষ্ঠ তালু শির ও বক্ষ– এই পাঁচ স্থান বিচরণের পর নিঃসৃত হয়ে যে স্বরের সৃষ্টি করে, তাকে বলে ‘পঞ্চম’ বা পা।
নাভি থেকে উৎপন্ন যে স্বর কণ্ঠ শির ও তালুতে করে
ললাটে আশ্রয় নিয়ে ধ্বনি সৃষ্টি করে, সেই স্বরকে বলা হয় ‘ধৈবত‘ বা ধা।
ঐ একই স্থান হতে উৎপন্ন স্বর কণ্ঠ তালু ও পরে শিরে আঘাত করে শিরেই অবস্থান নিয়ে ধ্বনি সৃষ্টি করে, সেই স্বরকে বলা হয় ‘নিষাদ‘ বা নি।
এই সাতটি স্বর বীর, করুণ, শান্ত, হাস্য, শৃংগার, মধুর, বীভৎস, ভয়ানক, রসের দ্যোতক।
সৃষ্টি হয়েছে স্বরের সুক্ষাংশ শ্রুতি। নাদ থেকে স্বর, স্বর থেকে সপ্তক এবং সপ্তক থেকে ঠাট– এই হল সংগীতের ক্রম।
সংগীতের প্রতিটি স্বরই রসসিক্ত। শ্রুতি মাধুর্যে ভরা স্বর আর শ্রুতি দিয়ে তাই মানুষ গড়ে তোলে তার ভানস প্রতিমা, যা প্রাণ আর লাবণ্যে ভরে দেয় জনচিত্ত। সুরের রসে অবগাহন করে শিল্পী হয় আনন্দে উদ্বেলিত। তার সাধনা পায় সিদ্ধি।
লেখক: লোকসংগীত শিল্পী, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।