সংগীতের নান্দনিকতা

ইকবাল হায়দার | বৃহস্পতিবার , ২৯ মে, ২০২৫ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

হাওয়ার উপর হাওয়া দিয়ে সংগীত তৈরি হয়। কিন্তু কেউ জানেনা সংগীতের আবিষ্কারক কে। প্রথম সংগীত তৈরির চেষ্টা হয়েছিল শব্দ ও ছন্দ দ্বারা প্রকৃতির সাহায্যে। তাই সংগীত শব্দের বিন্যাস, যা কিছু রূপ, সুর, ছন্দ বা অন্যথায় অভিব্যক্তি পূর্ণ বিষয়বস্তুর সমন্বয়ে তৈরি হয়। ধ্বনি, স্বর, ভাষা ও সুরের সৃষ্টি থেকেই সংগীতের যাত্রা। মানুষ সৃষ্টির সংগে সংগে কণ্ঠ সংগীতের উদ্ভব তার সংগে সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ বেদনা, রাগ অনুরাগ, প্রকাশের জন্য সুরের ব্যবহার শুরু হয়। আসলে সংগীত নামটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত একটি ইউনিসেক্স নাম। এটি সংস্কৃত শব্দ ‘সঙ’ অর্থ গান এবং ‘গীত’ অর্থ সংগীত থেকে উদ্ভুত এবং আক্ষরিক অর্থ সংগীত ও গান।

সংগীতের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক, জ্ঞানীয় বিজ্ঞান, নৃসংগীতবিদ, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী, ভাষাবিদ, স্নায়ু বিজ্ঞানী, জীবাশ্ম বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানীদের অবদান স্মরণীয়।

চার্লস ডারউইন তার গ্রন্থ ‘দ্যা ডিসেন্ট অফ ম্যান, এন্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স’ (১৮৭১) এ উল্লেখ করেছেন ‘জৈবিক প্রয়োজনে সংগীতের সৃষ্টি’। যা হারবার্ট স্পেন্সার, রিচার্ড ওয়াগনার, স্টিভেন যমহেন প্রমূখরা সমর্থন করেছেন। অনেকের ধারণা সংগীতের উদ্ভব হয়েছিল একটি সামাজিক বাস্তব প্রয়োজন মেটানোর জন্য। যেমন: সমন্বিত শ্রম সংগঠন, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, ঈশ্বর বা দেবতার সংগে সংযোগ, সমন্বয়, সংহতি ও সহযোগিতা এবং শত্রু ও হিংস্র জীব জন্তুকে ভয় দেখানো। সে যাই হোক অনেকভাবে আবর্তন, পরিবর্তন, বিবর্তন ও রূপান্তরের মাধ্যমে যে সংগীত আমাদের মধ্যে প্রসারিত, চর্চিত, বিস্তৃত হয়ে চলেছে, তাকে মানুষ যে সকল কারণে হৃদয়ের মধ্যে স্থান দিয়েছে তার মূল কারণ সংগীতের সৌন্দর্য বা নান্দনিকতা। আমরা আমাদের চর্চিত কাঠামোতেই সংগীতের সৌন্দর্য বা নান্দনিকতার স্বাদ নেবার চেষ্টা করব।

আমাদের সংগীতের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগেই আমাদের আবেগ, বুদ্ধি, মনস্তত্ত্ব ও আত্মার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সুর, গতি, বিচরণ, বুদ্ধি আবেগ, কাব্য সৃষ্টি ও সংগীতের মধ্যে গল্প বলা সংগীতের নান্দনিকতার অংশ।

নান্দনিকতা বা সৌন্দর্য দর্শনের একটি উপ শাখা যা শিল্পের প্রকৃতি, সংগীতের সৌন্দর্য, রুচি এবং সংগীতের সৌন্দর্যের সৃষ্টি ও উপলব্ধি নিয়ে আলোচনা করে যেমন ছন্দ, সুর, মাত্রা, লয়।

সংগীত যেমন আমাদের বুদ্ধি ও মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করে, তেমনি একাকীত্বকে প্রশমিত এবং আবেগকে উত্তেজিত করে। গীতিকবিতা, সাদৃশ্য, সম্মোহন, আবেগ, প্রবন্ধ রচনা, সময়গত গতিশীলতা, অনুরণন, রঙ, চিত্রকলা সৃষ্টিই সংগীতের সৌন্দর্য বা নান্দনিকতা।

আমরা জানি গীত, বাদ্য, নৃত্যই একসংগে সংগীত। গীত একধরনের শ্রবণযোগ্য বাণী যা সুসংবদ্ধ শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে পারে। এটি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি বা যন্ত্রোৎপাদিত ধ্বনি। বাণীবন্ধ কথা সুর ও তালের সমন্বয়ে গীত প্রকাশিত হয়। সুর ও তালের মিলিত ভাব বাদ্য। ছন্দের সাথে দেহ ভংগীমায় নৃত্য গঠিত হয়।

শিল্পীর কণ্ঠস্বরের কাব্যিকতা, ভাবময়তা, তন্ময়তা, শ্রোতার উপলব্ধিতে আঘাত করতে পারাই এর সৌন্দর্য ও স্বার্থকতা। সুরের কাঠামো, স্কেল, শোনার সৌন্দর্য, স্মৃতির গভীরে প্রবেশ ও অনুভূতি, আবার হাসাতে কাঁদাতে পারা, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ও আবহ সৃষ্টি করাই সংগীতের সৌন্দর্য। যেমন ঈশ্বর নিজের সবচেয়ে মায়াময় এবং বিমূর্ত শিল্পরূপসংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

শৃঙ্খলা, সুর, তাল, লয়, ছন্দ, গতি, চলন সংগীতকে সৌন্দর্যময়তা দান করে। সংগীতের চেয়ে শৃংখলার বৃহত্তর প্রকাশ আর কিছুতে নেই। শিল্পী গাইবেন আর দর্শক মনোযোগী হয়ে তার মধ্যে ডুব দেবেন সেই সংগীতে যা মোহাবিষ্ট করে হাজার হাজার দর্শকদের সেইতো নান্দনিক সংগীত। গায়নের শৈল্পিকতায় যদি হারিয়ে না যায় অগণিত সুর পিয়াসী, যদি শিল্পী অগণিত সংগীতানুরাগীদের হৃদয়েদের তানপুরাতে সুরের আলোড়ন সৃষ্টি করতে না পারে তা সার্থকতা কৈ? গীতিকবিতা সৃষ্টি, সাদৃশ্য, সম্মোহনবাদ, আবেগপ্রবণতা, সময়গত গতিশীলতা, অনুরণন, খেলাধুলা ও রঙ সৃষ্টিই সংগীতের নান্দনিক দিক। যা গীত, বাদ্য, নৃত্য এই তিনটি বিষয় দিয়ে বোঝানো সম্ভব।

সংগীত প্রাণের জিনিস, সংগীত শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। সংগীতকে সুন্দরভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়।

মানব হৃদয় প্রকৃতির অনুগত। ঊষার রঙিন আভায়, শীতল সমীরণে যেরূপ প্রফুল্লতা থাকে, মধ্যাহ্নের রৌদ্র প্রখর কিরণ তদ্রূপ হয় না। সূর্যের তীব্র তাপে শরীর যেরূপ বাহ্যত উত্তপ্ত ও শুদ্ধ হয়, হৃদয়ও সেরূপ শুষ্ক হয়ে যেন কিসের একটা অভাব অনুভব করে। আবার সন্ধ্যায় রঙিন আকাশ, সুশীতল বায়ু শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য ও অন্তরে আনন্দ উৎপন্ন করে ঐ রূপ প্রকৃতির শোভা দর্শনে প্রবল ব্যাত্যাযুক্ত ঝটিকা মেঘের গভীর গর্জনে যার অশনিপাত শ্রবণে ভীতি সমুৎপাদিত হয়। সংগীতেও তার সমরূপ সমূহ উপস্থিত থেকে রাগ অনুরাগ বিরাগের করুণ সুর উদ্ভাসিত করে। প্রাচীন সংগীতকার গন এই কালোপযোগী হৃদয় গত প্রকাশই ঘটিয়েছেন সংগীত রচনার মাধ্যমে। সময়ের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন সংগীত ও রাগ রাগিনী। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি এখানে স্মরণীয়। তার মতে, ‘যাহা কোনো মতে বলিবার জো নাই তাহা এই সংগীত দিয়েই বলা চলে’।

যেমন সংগীতে আছে স্বর, শ্রুতি, রাগ, গ্রাম, অলংকার বর্ণ, ভাব, মূর্চ্ছনা, মহিমা, মাধুর্য ইত্যাদি। আছে ইতিহাস, ব্যাকরণ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও মনোবিজ্ঞান। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীগণ সত্য ও সুন্দরের, রূপের উপাসক, সুন্দরের পূজারী। এই সুন্দরকে উপলব্ধি করার মূল সে যে মানুষের মন। সংগীত মানুষের চিত্ত বিনোদন বা মনোরঞ্জন করে। ভাব, সৌন্দর্য ও রাগ লালিত্যের সংযোজনের মাধ্যমেই সংগীতের সৌন্দর্য বা নান্দনিকতার অন্তর্নিহিত রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে ধরা দেয় মানব মনে।

লেখক: লোক সংগীত শিল্পী, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বমানের কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম