জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন বলেছেন, ২০২১ সালে দুর্গাপূজায় বিভিন্ন মণ্ডপে হামলা ও সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল সেখানে বিন্দুমাত্র সত্যের অপলাপ ছিল না। কিন্তু সেটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যা দুঃখজনক। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তার বক্তব্য ‘টুইস্ট’ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন।
‘দেশে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি’-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই সময়ে দেয়া বক্তব্যের বিষয়টি সভা মঞ্চে আয়োজক কমিটির বেশ কয়েকজন বক্তার বক্তব্যে উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একবছর আগে পূজার সময় কুমিল্লায় একটি দেবতার কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে একটা ছবি তোলা হয়। ওটা ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়ার পর কিছু লোক ওখানে আক্রমণ করে। আক্রমণ থামাতে গিয়ে পুলিশ গুলি করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে তখনও আমরা কিন্তু কুড়িগ্রামের কাহিনী জানতাম না। তখন আমাদের মন্ত্রণালয় যেসব কথা বলেছে, সত্যি কথা বলেছে। আমি শিক্ষক লোক, সত্য কথা বলি। আমরা বলেছি, তখন পর্যন্ত মোট ছয়জন লোক মারা যায়। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল, চারজন মুসলমান, দুজন হিন্দু। তবে আমরা একজন লোকও মারা যাক সেটা চাই না।
আব্দুল মোমেন বলেন, এখানে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনেকে গল্প বলেছে, এটা খুবই দুঃখজনক। আমি যেটা করেছি, তা বিবেকের তাড়নায় করেছি। কিন্তু এটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, টুইস্ট করে আপনাদের কাছে বলা হয়েছে। আমি বলছি- কোথাও সত্যের অপলাপ হয়নি। জেনেশুনেও আপনারা যদি প্রতিক্রিয়া দেখান, তাহলে এটা তো বড় মুশকিল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কিন্তু বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, বিভিন্ন প্রচারণায় বের হল যে কয়েকশত নারী নির্যাতিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে। অথচ একজন নারীও ধর্ষিত হয়নি। আপনারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন, কুমিল্লার সময় কোনো নারী রেপ হয়েছে। নো, সেটি আমরা বলেছি, সত্য কথা বলেছি।
তিনি বলেন, ‘১৭-১৮টা বাড়ি ভেঙ্গে ফেলেছিল। সরকার সবগুলো বাড়ি মেরামত করে দিয়েছে, তাদের আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে। আমরা এমন কাজ করব না, ফুলিয়ে ফাপিয়ে এমন উসকানি দেব না যাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে একটি প্রবাদবাক্য আছে। চিলে কান নিয়ে গেছে। কান আছে কি না সেটা ধরে দেখে না, কান নিয়ে গেছে বলে চিৎকার শুরু করে। আমাদের এখানেও কিছুসংখ্যক লোক এই ধরনের অবস্থানে আছে।
ভারত সফরের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি, আমার দেশে কিছু দুষ্টু লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমাদের দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না। আপনার দেশেও যেমন দুষ্টু লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে তাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা কিছু কথা বলেছিলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এই ধরনের প্রোটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরও সোচ্চার হয়ে আরও বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হবে। স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ভারতকে বলেছি, আমরা উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড কখনও প্রশ্রয় দেব না। এটা যদি আমরা করতে পারি, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের মঙ্গল। শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। ২৮ লাখ লোক আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ভারতে বেড়াতে যায়। ভারতের কয়েক লাখ লোক আমাদের দেশে কাজ করে। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের সুন্দর অবস্থানের কারণে। সুতরাং আমরা উভয়ে এমনভাবে কাজ করব যাতে কোনো ধরনের উসকানিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। ভারত সরকারকে বলেছি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে যদি আমরা উভয়ে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিই।
তিনি বলেন, আমি সেখানে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সামপ্রদায়িকতামুক্ত অসামপ্রদায়িক একটা দেশ হবে। সেজন্য শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি সেটা অনুরোধ করেছি।
৭৫ এর ১৫ অগাস্ট পূর্ববর্তী সময়ের মতো দেশে আবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস খুনের আগে কত বাহানা আসলো। বঙ্গবন্ধুর পরিবার নাকি ব্যাংক লুট করেছে। জাল পরিয়ে ছবি দিয়ে বলা হল যে দেশ নাকি বাসন্তীর মতো হয়ে গেছে। এভাবে মিথ্যা প্রচারণা ছড়িয়ে একটি পরিস্থিতি তৈরি করে তারপর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এখনও আবার সেই ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের লোক দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা শুরু করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা- এটা মনে রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানে সংবর্ধেয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আর্শীবাদক ছিলেন বাঁশখালী ঋষিধামের মোহন্ত স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী মহারাজ।
মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সাধারণ সম্পাদক শ্রীমৎ স্বামী শক্তিনাথানন্দজী মহারাজ। জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ-কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুকুমার চৌধুরীর সভাপতিত্বে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এমপি, ঢাকা মহানগর জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক এস কে সিকদার। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ-কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন, শোভাযাত্রা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক মাইকেল দে, সদস্য সচিব রতন ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি দুলাল চন্দ্র দে ও সাধারণ সম্পাদক লায়ন শংকর সেনগুপ্ত, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ কুমার ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল দাশ উজ্বল।