সাধারণত কোনো রোগে আক্রান্ত হলে রোগীরা নিরাময় পেতে হাসপাতালে ছুটে যান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যথাযথ সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় দিনদিন হাসপাতালই হয়ে উঠছে রোগ বিস্তারের কেন্দ্র’। এতে পুরো হাসপাতাল এলাকা জীবাণুতে ভরে যাচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছে অন্য জীবাণুতে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘একটি রোগ থেকে মুক্তি পেতে হাসপাতালে এসে রোগীরা অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। রোগভর্তি রোগীদের সুস্থ হতে সময় লাগছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে কয়েক গুণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের সম্ভাব্য জায়গাগুলোর মধ্যে হাসপাতাল অন্যতম। বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ৩৭ লাখ মানুষ মারা যায় সংক্রমণজনিত কারণে। এর বড় অংশই হাসপাতালে সংক্রমিত। পশ্চিমা দেশগুলোতে সংক্রমণের হার ৩ থেকে ৫ শতাংশ হলেও এশিয়ান দেশগুলোতে এই হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) সাপোর্ট প্রোগ্রামগুলো বেশি জরুরি। কারণ এসব দেশে স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ও মেডিক্যাল হাইজিন স্ট্যান্ডার্ডগুলো সেকেন্ডারি সংক্রমণের মাধ্যমে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।’
গত ৭ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘হাসপাতাল এলাকায় দোকানের ফলে ২৭ ধরনের জীবাণু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোগীর সুস্থতার জন্য চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতাল এলাকা থেকে সংগৃহীত ফল পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে না খাওয়ায় অনেকেই উল্টো বিভিন্ন জীবাণুতে সংক্রমিত হচ্ছেন।
দেশীয় চিকিৎসকদের এ গবেষণায় দেখা গেছে, ফলে থাকা ২৭ ধরনের জীবাণুতে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। মূলত সংক্রমণের উৎসগুলো জানতে এ গবেষণা চালানো হয়। গত সোমবার সহকারী গবেষক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাকলী হালদার বলেন, হাসপাতালে অনেক রোগজীবাণু থাকে। রোগীদের পাশাপাশি এখানে চিকিৎসক–নার্স, ওয়ার্ডবয়, স্বজনসহ প্রত্যেকের হাঁচি–কাশির মাধ্যমেও জীবাণু ছড়াচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একদল চিকিৎসক হাসপাতাল এলাকায় ফলের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণের গবেষণাটি করেন। এতে দেখা যায়, হাসপাতালের আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা ফল থেকে যে ২৭ ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটছে, তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী।
গবেষকরা ফলের মাধ্যমে জীবাণুতে সংক্রমিত হওয়ার কারণ হিসেবে হাসপাতালের দুর্বল সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) ব্যবস্থা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের প্রভাবকে দায়ী করছেন। ঝুঁকি এড়াতে হাসপাতালে যাওয়া রোগী, স্বজনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফল ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) একটি বাস্তব, প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতি, যা রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এড়িয়ে চলতে পারে এমন সংক্রমণ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধা দেয়। সংক্রমণ সম্ভাব্য জায়গাসমূহের মধ্যে হাসপাতাল হচ্ছে অন্যতম। হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত আউটকাম বের করতে হলে কার্যকরী সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। কার্যকরী আইপিসির জন্য নীতিনির্ধারক, হাসপাতাল ব্যবস্থাপক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সেবাগ্রহীতাসহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বস্তরে সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন। রোগীর নিরাপত্তা ও সেবার মানের ক্ষেত্রে আইপিসি একটি অনন্য ব্যবস্থা। কারণ এটি স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর জন্য এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি অভ্যন্তরীণ কাজে সর্বজনীনভাবে প্রাসঙ্গিক। যথাযথ আইপিসি ব্যবস্থাপনার অভাবে সেবা প্রদানকারী হাসপাতালগুলোই হতে পারে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক বড় ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। ত্রুটিপূর্ণ আইপিসি ব্যাপক ক্ষতির কারণ এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই একটি বাস্তবমুখী কার্যকর আইপিসি ছাড়া মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করা অসম্ভব।’
হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট মুহাম্মদ জাকির হোসেন তাঁর এক লেখায় বলেছেন, হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন– রোগীদের নিম্নমানের জীবনযাপন, দারিদ্র্যতা, স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে দুর্বলতা, পুরনো ও সংকুচিত ক্লিনিক বা হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অতিরিক্ত ভিড়, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল, সম্পদ, সরঞ্জাম ও সুবিধার অভাব, মেডিকেল ডিভাইসসমূহের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, দূষণমুক্তকরণ ও পুনর্ব্যবহার, স্বাস্থ্যকর্মীদের স্ট্যান্ডার্ড প্রিকুয়েশন সংক্রান্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যেমন– হাতধোয়ার বিধি, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার, শার্পস– লিলেন ও বর্জ্য পরিষ্কার ও দূষণমুক্তকরণ, উত্তম অনুশীলনসমূহ নির্ণয় ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পদ্ধতি, পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা যেমন– দেয়াল, মেঝে, পৃষ্ঠ, পরীক্ষার বেড ও অন্যান্য আসবাবপত্র ইত্যাদি। উপরোক্ত চ্যালেঞ্জ ছাড়াও নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে মূলত চারটি প্রধান বাধা রয়েছে : আর্থিক সহায়তার অভাব, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কর্মরত দক্ষ কর্মীদের অপর্যাপ্ত সংখ্যা, হাসপাতালসমূহে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী এবং অপর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও সরবরাহ।
বিশেষজ্ঞরা হাসপাতালে থাকার সময় রোগী ও স্বজনদের যতবার সম্ভব হাত ধোয়া ও মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, রোগীর একজনের বেশি স্বজন হাসপাতালে থাকা উচিত নয়। এছাড়া রোগীর কক্ষে প্রবেশের আগে মাস্ক পরার পাশাপাশি রোগীর সঙ্গে হাত মেলানো বা গায়ে হাত বোলানো এবং তার বিছানায় বসা থেকে বিরত থাকা জরুরি। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।