সংকুচিত হচ্ছে বন্যহাতি চলাচলের পথ

চুনতি অভয়ারণ্য

মোহাম্মদ মারুফ, লোহাগাড়া | বুধবার , ১৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

লোহাগাড়ার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বন্যহাতির প্রাকৃতিক চলাচলের পথ দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, জনবসতির বিস্তার ও বনভূমি দখলের কারণে এই সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। ফলে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের চাপ প্রাণীদের এই পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে।

জানা যায়, লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। যা এশিয়ান হাতিসহ নানা বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত। চুনতি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মাঝ দিয়ে গেছে চট্টগ্রামকক্সবাজার মহাসড়ক ও রেললাইনের প্রায় ১০ কিলোমিটার অংশ। মহাসড়কের পূর্ব পাশে সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর পশ্চিম পাশে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এ অংশে বন্যহাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী চলাচলের ১৩টি করিডোর চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব করিডোর ও আশপাশে মানবসৃষ্ট বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে রোড সাইন, গার্ডরেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সাইনবোর্ড, সীমানা গেট, দূরত্ব চিহ্নিতকারী পিলার ও রাতে বৈদ্যুতিক বাল্বের আলো ইত্যাদি। বিশেষ করে হাতির মতো বৃহৎ প্রাণীর জন্য নির্মিত এলিফ্যান্ট ওভারপাসও এখন কার্যকারিতা হারাচ্ছে। কারণ বন্যপ্রাণী পার হতে গিয়ে পড়ছে মানুষের ভিড়, যানবাহনের হর্ন ও চোখ ধাঁধানো আলো। এর ফলে বন্যপ্রাণীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে করিডোর থেকে। এভাবে চলতে থাকলে শুধু বন্যপ্রাণী নয়, পুরো বনের ইকোসিস্টেম হুমকির মুখে পড়বে। এখনই সময়, পরিকল্পনাহীন স্থাপনাগুলো সরিয়ে প্রকৃতির চলাচলের পথকে ফিরিয়ে দেওয়া। নরম মাটি, ঝরনা আর ভূগর্ভস্থ পানি প্রবাহের কারণে এই বনটি হাতির প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, মহাসড়কের চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কার্যালয়ের গেট থেকে চুনতি সংরক্ষিত বনের সাতগড় বিট অফিস এলাকা পর্যন্ত জাঙ্গালিয়ার আধা কিলোমিটার অংশে কয়েকটি বন্যহাতি চলাচলের করিডোর রয়েছে। এরমধ্যে একটি রেললাইনে নির্মিত এলিফ্যান্ট ওভারপাসে যাবার করিডোর। বর্তমানে এ করিডোর দিয়ে বন্যহাতি চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া মহাসড়কের পাশে অপরিকল্পতভাবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সীমানা গেট, রোড সাইন, গার্ডরেল, সীমানা গেট ও সাইনবোর্ড স্থাপনের কারণে অন্যান্য করিডোর দিয়ে বন্যপ্রাণী চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি ওই এলাকায় পর পর কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকে হতাহত হয়েছেন। এরপর সড়ক ও জনপথ বিভাগ অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য রোডসাইন ও রাম্বল স্ট্রিপ স্থাপন করেছে। এসব রোডসাইনে রাতে যানবাহনের আলো পড়লে ঝলমল করে। রাম্বল স্ট্রিপ স্থাপনের ফলে যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় নির্জন এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে অন্ধকার দূর করতে লাগানো হয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্ব। এতে অপরিকল্পিত স্থাপনা ও আলোর কারণে হাতিসহ বন্যপ্রাণী চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অপরদিকে, মহাসড়ক থেকে এলিফ্যান্ট ওভারপাসে যাতায়াতের করিডোরের মুখে দেখা গেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাইনবোর্ড, রোডসাইন, গার্ডরেল, দূরত্ব চিহ্নিকারী পিলার ও বৈদ্যুতিক খুঁটি। পাশেই রয়েছে কঙবাজার সড়ক বিভাগের স্বাগতম লেখা গেট ও অল্প দূরত্বে চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের ধন্যবাদ লেখা গেট। এলিফ্যান্ট ওভারপাস হয়ে বন্যহাতি সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর অভয়ারণ্যে যাতায়াত করতে এসব মানবসৃষ্ট বাধা অতিক্রম করতে হয়। এছাড়া মহাসড়কের বনের অন্যান্য করিডোরেও বিভিন্ন মানবসৃষ্ট বাধা দেখা গেছে। যা বন্যপ্রাণীর জন্য খুবই বিব্রতকর। হাতির স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী। তারা নির্দিষ্ট করিডোর দিয়ে চলাফেরা করে, যেটি তাদের পূর্বপুরুষরা ব্যবহার করে এসেছে। এ পথ বাধাগ্রস্ত হলে তারা দিক ভ্রান্ত হয়ে যায়।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী সানজিদা রহমান জানান, বন্যহাতি আমাদের জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আজ উন্নয়নের নামে যেভাবে এলাকা ভাগ করে করিডোরে মানবসৃষ্ট বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে তাদের প্রাকৃতিক চলাচলের পথ হচ্ছে সংকুচিত। বিশেষ করে এলিফ্যান্ট করিডোরে মানবসৃষ্ট বাধা, শব্দদূষণ, রোডসাইন ও যানবাহনের গতি সবই হাতির জন্য হুমকি। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে বিকল্প ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে চলাচল করতে। আমরা চাই উন্নয়ন হোক পরিবেশবান্ধবভাবে। যে পথে হাতি শত বছর যাবত চলাচল করছে, সেই পথ নিরাপদ রাখতে হবে। না হলে এই মহাবিপন্ন প্রাণীরা এক সময় হয়তো চিরতরে মুখে ফিরিয়ে নেবে এই বনভূমি থেকে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফ জানান, জাঙ্গালিয়া এলাকায় রোডসাইনসহ বিভিন্ন সড়ক সুরক্ষা স্থাপনের কারণে বন্যহাতি চলাচলে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে বনবিভাগ তাদেরকে অবগত করেনি। সম্প্রতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় অল্প দূরত্বে ঘন ঘন রোডসাইন স্থাপন করা হয়েছে কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, যারা রোড সেফটি অডিট করেছেন তাদের মতে সড়কের নিরাপত্তার জন্য আরো রোডসাইন স্থাপনা করা প্রয়োজন।

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা নুর জাহান জানান, জাঙ্গালিয়া এলাকায় বন্যহাতি চলাচলের কয়েকটি করিডোর রয়েছে। সম্প্রতি ওই এলাকায় সড়ক সম্প্রসারণের পরে বন্যহাতি চলাচলের পথে রোডসাইনসহ সড়ক সুরক্ষার বিভিন্ন সরঞ্জাম স্থাপনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বনবিভাগকে অবগত করেনি। মূলত বন্যপ্রাণীরা ওই স্থান দিয়ে রাতেই চলাচল করে। এভাবে ঘন ঘন রোডসাইন স্থাপন ও রাতে আলো জ্বালিয়ে রাখলে হাতিসহ বন্যপ্রাণী চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। বন্যপ্রাণী চলাচলে পথ সুগম রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হাতি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ জানান, বন্যহাতির চলাচলের নির্দিষ্ট করিডোর থাকে। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা অনুসরণ করে। এই করিডোরে হঠাৎ করে মানবসৃষ্ট বাধা ও লাইটের আলোতে আলোকিত হলে তা হাতির আচরণে সরাসরি প্রভাব ফেলে। হাতি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রাণী। সামান্য পরিবর্তনেও তারা দ্বিধায় পড়ে চলাচলের পথ বদলে ফেলে। নিরাপদ করিডোর নিশ্চিত করতে হলে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। হাতির জন্য পরিচিতি, নিরিবিলি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। নিরাপদ পরিবেশ না থাকলে হাতিরা সেই পথ পরিহার করবেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতিসংঘ পদক পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের নারী কন্টিনজেন্ট
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা