‘সুপেয় পানি নিয়ে উদ্বেগ ওয়াসার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে গত ১৮ মে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামবাসীর প্রতিদিনের ৫০ কোটি লিটার সুপেয় পানির যোগান দিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার চারটি পানি শোধনাগার। ওয়াসার এই চারটি পানি শোধনাগার প্রতিদিন হালদা এবং কর্ণফুলী থেকে মিঠা পানি পরিশোধন করে নগরীতে সরবরাহ করে। বছরের ছয় মাস (মে থেকে অক্টোবর) কর্ণফুলী এবং হালদায় পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসা নির্বিঘ্নে পানি উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু যত বিপত্তি নভেম্বর থেকে এপ্রিল; এই ছয় মাস হালদা এবং কর্ণফুলীতে পানি প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। তখন চট্টগ্রাম ওয়াসাকে নগরবাসীর প্রতিদিনের চাহিদা মোতাবেক পানি উৎপাদনে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত এক দশক ধরে কর্ণফুলী নদীতে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) পানি প্রবাহ ক্রমশ কমতে থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা; বেড়েছে উদ্বেগ। সমপ্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি বিশেষজ্ঞ টিম (ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে) কালুরঘাট থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত নদী পথে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এসময় বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যরা নদীর কোন জায়গায় পানির লেভেল কত সেটা পরীক্ষা করেন এবং বছরের পাঁচ–ছয় মাস নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ তাদের পর্যবেক্ষণে শনাক্ত করা হয়।
প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। এতে তাঁদের অভিমত হলো, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি নির্গমণ একেবারেই কমে যায়। যার ফলে হালদা নদীতে মিঠা পানির প্রবাহের পরিমাণ কমে যায়। এ সময় হালদায় উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ায় কর্ণফুলী নদীর জোয়ারের লবণাক্ত পানি হালদায় প্রবেশ করে। হালদা নদীর যে পয়েন্ট থেকে ওয়াসা মোহরা প্রকল্পের পানি সংগ্রহ করা হয় সেখানে গত এপ্রিল মাসে লবণের পরিমাণ প্রতি লিটারে ১৭০০ মিলিগ্রাম ছিল। স্বাভাবিক সময়ে এই লবণের পরিমাণ থাকে প্রতি লিটারে ১০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম। একই অবস্থা মদুনাঘাটস্থ শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পেরও। এভাবে পানির প্রবাহ যেমন কমতে থাকে–তেমনি বাড়তে থাকে লবণের মাত্রা। এই অবস্থা আগামীতে অব্যাহত থাকলে আগামী ৩–৪ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী সুপেয় পানির বিপর্যয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কর্ণফুলী এবং হালদাকে বাঁচানোর জন্য এখনই চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত। এই ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপও দরকার। কাপ্তাই লেক খনন করতে হবে। কর্ণফুলীর এই অংশে নিয়মিত ডেজিং করতে হবে। নির্বিচারে বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা এবং পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বিশেষ কাজ হলো নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা, শিল্প এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্যানিটেশন এবং ভাল স্বাস্থ্যকর অবস্থা নিশ্চিত করতে গার্হস্থ্য এবং অন্যান্য পয়ঃনিষ্কাশনের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা এবং চট্টগ্রাম শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দ্রুত বর্ধনশীল শহরের সেবায় ওয়াসা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রদানের সময় ওয়াসাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন– ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাল ও নদী–নালার অভাব, শহরের ঘনবসতি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, ভূ–উপরিস্থ পানি কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের মাধ্যমে ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া, নগরবাসী কর্তৃক অবৈধ পানি ব্যবহার প্রবণতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করতে হয় ওয়াসাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পরিসংখ্যান নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। খাল–বি–নদী দখল ও দূষণ, রাসায়নিক ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার, উপকূলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দেশে নিরাপদ পানির উৎস সংকুচিত হয়েছে। সারফেস ওয়াটারের বদলে মাটির নিচের পানির ওপর বিপজ্জনক নির্ভরতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নিরাপদ পানির সংকটকে কাজে লাগিয়ে পানির বাণিজ্যিকীকরণ। ফলে চড়া মূল্যে বোতল কিংবা জারের পানি কিনে খাওয়া এখন স্বাভাবিক বাস্তবতা। এ পরিস্থিতির পরিবর্তনে পানিকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। দেশের সব মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
নগরীতে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা একটি জটিল কিন্তু অপরিহার্য কাজ, যার জন্য সকল অংশীদারের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একটি স্বাস্থ্যকর শহরে প্রতিটি বাসিন্দার জন্য পরিষ্কার এবং নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা ওয়াসার দায়িত্ব। নগরজুড়ে পানির যে হাহাকার চলছে, তা অচিরেই বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সুপেয় পানি নিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার যতই উদ্বেগ থাকুক না কেন, সংকট সমাধানের উদ্যোগ ওয়াসাকেই নিতে হবে।