সংকট অনেক গভীরে

শঙ্কর প্রসাদ দে | রবিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

১৩ অক্টোবর ২০২১ থেকে সপ্তাহ ধরে হিন্দুদের উপর অব্যাহত হামলা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। শেখ হাসিনার মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের শাসনামলে এতো বিস্তৃত পরিসরে হিন্দুদের প্রতি সহিংসতা কেমন করে সম্ভব হলো? মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ সংগঠন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিক লীগের (আরো অনেক সংগঠন আছে যাদের নাম আমার জানা নেই) কর্মীরা কেন হামলা হতে যাচ্ছে জেনেও এগিয়ে গেল না? চৌমুহনীর ঘটনাতো রীতিমতো অশনি সংকেত। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা জানতেন শুক্রবার নামাজের পর হামলার আশঙ্কার কথা। তারা স্বীকারও করেছেন বৃহষ্পতিবার বিকালবেলা চৌমুহনীর ২টি থানা এলাকায় মাইকিং হয়েছিল। আমরা দেখলাম, নামাজের পর আনুমানিক ২ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত মধ্যযুগীয় পৈশাচিকতায় ইসকন, রামঠাকুর মন্দির সহ সমস্ত দেবালয়গুলোতে তান্ডব অব্যাহত থাকে। হামলাকারীদের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ শ’য়ের মধ্যে হবে। প্রশ্ন হলো প্রশাসন কেন পর্যাপ্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিডিআর নামায়নি? ৪ ঘন্টা ধরে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তনাদ কানে পৌঁছার পরও নোয়াখালীর প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠালেন না। এর সহজ ব্যাখ্যা হলো, তোমরা যা করার করে চলে যাও। চাঁদপুরের এস.পি মিলন মাহমুদ গুলির নির্দেশ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এখনো অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১২টি জেলায় শত শত মন্ডপ ও মন্দির ভাঙচুর হয়েছে এবং চৌমুহনীতে যতন সাহা, প্রান্ত দাশ ও দীলিপ দাসের হত্যা স্বীকৃততথ্য। তথ্য ষ্পষ্ট না হলেও সিলেটে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ বাতাসে ঘুরছে। কুমিল্লার সংশ্লিষ্ট ও.সি কোরআনটি উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারপর্বটি উস্কানিমূলক ভাবে লাইভ প্রচার করা হলো। ওসি সাহেব তাৎক্ষণিকভাবে সেটা নিবৃত্ত করেননি। বুঝলাম মুসলিম জনগণের একটি ক্ষুদ্র অথচ যুদ্ধংদেহী অংশ হয়ে উঠেছে চরম সংখ্যালঘু বিদ্বেষী। রামুর ঘটনা আর চৌমুহনীর ঘটনার চরিত্র একই। ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধমন্দির হামলায় যুদ্ধংদেহী জনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী পরিবারের স্থানীয় নেতৃত্ব। হাজীগঞ্জ ও পীরগঞ্জে সরাসরি আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের নাম উঠে এসেছে। ২০১২ এবং ২০২১ সালের ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, পুলিশ প্রশাসনের, সিভিল প্রশাসনের শক্তিশালী একটি অংশ আওয়ামীলীগ, বিএনপি নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছোট একটি অংশ হয়ে উঠেছে, সংখ্যালঘু বিদ্বেষী। দিনকে দিন হিন্দু বিদ্বেষী এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশ্ন হলো কেন?
পূর্ব-বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সূত্রপাত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে। সাতচল্লিশের দেশভাগ এক ধরনের ইসলামী পরিণতি নিয়ে আসে। মুসলমানদের দেশ পূর্ব-বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে বিতাড়িত করা হল। ১৯৪৬ এর ১১ অক্টোবর নোয়াখালীতে হিন্দু নিধন যজ্ঞের মূল লক্ষ্যই ছিল হিন্দুদের বিতাড়িত করা। পূর্ব- বাংলা হলো পূর্ব-পাকিস্তান। ১৯৭১ এ এসে ঐতিহাসিক যে ঘটনাটি ঘটল তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। এ জাতির সৌভাগ্য হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ব্যক্তিগতভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং এক ঝাঁক সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী বাঙালি জাতিসত্তাকে অনেকটা পরিপূর্ণ রূূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর আমরা খুশীতে গদগদ হয়ে বলতে লাগলাম হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সমাপ্তি হয়েছে।
আমরা খেয়াল করলাম না যে, যে ভূমিখেকো হিন্দুর সম্পত্তির উপর নজর রাখছিল, সে অসন্তুষ্ট হলো। বায়াত্তরে হিন্দুরা যদি ফেরৎ না আসতো তবে সাম্প্রদায়িক সমস্যার বর্তমান চেহারার উদ্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই ১৯৭২ সালে অষ্টমী পূজার দিন একযোগে গোটা দেশে হামলা চালানো হল। এটার সহজ ব্যাখ্যা হলো, ভূমি দস্যুরা বুঝাতে চেয়েছে তোমার গিয়েছিল তো ভালই হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছো তো ভালোই। তোমরা কেন ফিরে এলে? খাতুনগঞ্জের মুসলিম ব্যবসায়ীরা দেখল আবার যে বাবুরা এসে গেল। হিন্দু হেডমাস্টারের জন্য মুসলিম শিক্ষকটি হেডস্যার হতে পারছিল না। অধ্যক্ষ গোপাল মুহুরি হত্যাকাণ্ডটি তার প্রমাণ। স্বর্ণের ও মহাজনী ব্যবসা একচেটিয়া হিন্দুদের হাতে থাকায় তাদের তাড়িয়ে দেয়া নিতান্ত স্বার্থের কারণে সামনে চলে আসে। এদেশের গ্রামের শতকরা নব্বইভাগ মুসলমান অসাম্প্রদায়িক কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী একটি গ্রুপ ঠিকই মুসলমানের বাংলাদেশ ভাবনা নিয়ে এগোল। আমরা আগে বাঙালি আর পরে হিন্দু বা মুসলমান- বঙ্গবন্ধুর এই দর্শনকে দ্রুত উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হল। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন, আমি আগে মুসলমান আর পরে বাঙালি তবে তাঁকে এভাবে মরতে হতো না।
মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের মীমাংসা হয়নি। সব মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি জাতিসত্তায়ও বিশ্বাস করতেন না। জিয়াউর রহমানতো সংবিধান সংশোধন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শব্দটিই কেটে দিলেন। ‘বিছমিল্লাহ’ শব্দ কোটি মানুষের কাছে নিশ্চিৎ একটি পুণ্যার্থবাহী শব্দ। জিয়া এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করলেন চমৎকারভাবে। সংবিধানের শুরুতে যোগ করলেন, ‘বিছমিল্লাহ’। বুঝা গেল বিরোত্তম জিয়ার মতো মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামী বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এরশাদ জিয়ার মুসলিম বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছেন দক্ষতার সাথে।
এতোক্ষণ ধরে সম্পত্তির লোভ, ব্যবসার লোভ নিয়ে যা বললাম তার সাথে যোগ হয়েছে রাজনীতি। এখন খোলাখুলি বলার সময় এসেছে, জিয়াপন্থী অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থীদের মূল বক্তব্য হলো হিন্দুদের ভোট’ই হলো আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তিকেন্দ্র। হিন্দুরা যত্ত বেশী ভারতে যাবে ততই বিএনপি পন্থীদের লাভ। সম্পত্তি লাভ, ব্যবসায় লাভ, পেশায় লাভ, চাকুরীতে লাভ ও ক্ষমতা লাভ মিলে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় শক্তিশালী এক মতাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে। এককথায় এটির নাম হিন্দু বিদ্বেষ বা ভারত বিদ্বেষ যা বাঙালি জাতিসত্তা বিদ্বেষী। এই বিদ্বেষ নিতান্তই আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক। এই বিরোধ অনেক গভীর।
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন হলেই কি সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব? আমার তা মনে হয় না। অনেকে বলেছেন, এসিড নিক্ষেপ ও হিরোইন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড চালু হওয়ায় অপরাধ কমে গেছে। মনে রাখতে হবে এসিড নিক্ষেপে ডাক্তারী সনদপত্র ও হিরোইন মামলায় পুলিশের সাক্ষ্যই দণ্ডাদেশের জন্য যথেষ্ট। বর্তমান আইনে দ্রুত বিচার বা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, যেখানেই বিচার হউক ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের এসে সাক্ষী দিতে হবে। অভিজ্ঞতা বলছে কেউ সাক্ষী দেবার সাহস দেখাবে না। আইনজীবী হিসেবে আমার প্রস্তাব হলো, “সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও নির্যাতন অপরাধ আইন” প্রণয়ন করে মৌখিক সাক্ষ্যের পরিবর্তে তথ্য প্রযুক্তি ও পুলিশি সাক্ষ্যের উপর বিচার অনুষ্ঠিত হবার ধারা সংযোজন করতে হবে। হিরোইন পাচার মামলায় শুধু পুলিশের সাক্ষ্য ও বিশেষজ্ঞের মতামতের উপর বিচার শেষ করা যায়। একই ভাবে ফেসবুকে যার ছবি দেখা গেছে তাকে বিশেষজ্ঞ দ্বারা সনাক্ত করা গেলে শুধু বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট আর পুলিশের সাক্ষ্যের উপর বিচার শেষ করা যাবে। কঠোর আইন, দ্রুত বিচার, নিশ্চিৎভাবে পরিস্থিতির স্বল্পমেয়াদী উন্নতি ঘটাবে। প্রশ্ন হলো সমাজের গভীরে যে হিন্দু বিদ্বেষ স্বার্থের কারণে, গোঁড়ামি ও রাজনীতির কারণে জেঁকে বসে আছে, সেখান থেকে বের হবার উপায় কি? উপায় হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে কঠোরতম পন্থা অবলম্বন কর। কারো যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভাল না লাগে তবে তিনি পাকিস্তানে বা আফগানিস্থানে চলে যেতেই পারেন। যেমন গিয়েছেন রাজা ত্রিদিব রায়। সম্পত্তির লোভ সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ‘ক’ তপশীল মামলায় অনেকে রায় পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করছে ডিসি অফিস আর ভিপি আইনজীবীরা। তাঁরা নিজ নিজ স্বার্থে খামোকা আপীল মামলা টুকে দিয়ে আরো ১০/২০ বছরের জন্য প্রত্যার্পণ ঝুলিয়ে দিচ্ছে। বাপ দাদার সম্পত্তি উদ্ধারে হিন্দুরা তহশীলদার, কানুনগো, এসিল্যান্ড, এডিসি ল্যান্ড অফিস সরকারী, ভিপি আইনজীবীসহ কোথায় উৎকোচ দেয়নি। ঘামেভেজা কচকচে নোট খরচ করেও গত অর্ধশতাব্দীর দুর্দশার শেষ যে আজো হলো না। কবে হবে তাও জানি না। তবুও আশার আলো দেখি, যখন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ তাদের দুঃখ বেদনা, উদ্বিগ্নতা জাতির সাথে শেয়ার করেন। তখন ভাবি এদেশে জন্মেছি, এদেশেই মরতে চাই। তাহলো বাঁচবো কেমনে। আমার সোজা প্রস্তাব, যত ঝড় ঝাপটা আসুক বায়াত্তরের সংবিধানে ফেরাই প্রথম এবং শেষ বিকল্প।
লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট; কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকতোটা রং মেলালে একটি স্বপ্নের ছবি আঁকা যায়?
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে