সংকটে বেসরকারি ১৯ আইসিডি

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৪:১১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠা বেসরকারি আইসিডিগুলোর অবস্থা নাজুক। আমদানি রপ্তানি কমে যাওয়ায় প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলা আইসিডিগুলো ব্যবসা সংকটে ভুগছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি আইসিডিগুলোর পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও চাল ডাল তুলাসহ আমদানিকৃত ৩৮ ধরণের পণ্য ডেলিভারি নেয়ার সুযোগ আবারো তিন মাসের জন্য বৃদ্ধি করায় অনেকটা হাহাকার শুরু হয়েছে। কাস্টমসের এমন নির্দেশনাকে টিকে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রামে থাকা আইসিডিগুলোকে নতুন সংকটে ফেলবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। অবশ্য কাস্টমস এবং সিএন্ডএফ এজেন্টদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ব্যবসার খরচ কমাতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রামে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলা হয় ১৯টি আইসিডি। শুরুতে এসব আইসিডি কেবলমাত্র খালি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতো। পরবর্তীতে খালি কন্টেনারের পাশাপাশি রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর অনুমোদন দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমের একটি বড় অংশ বাইরের আইসিডিতে চলে আসায় বন্দরের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, বৃদ্ধি পায় কাজের গতিশীলতা। এক পর্যায়ে রপ্তানি কন্টেনারের পাশাপাশি বেশ কয়েক ধরনের পণ্য নিয়ে আসা আমদানি পণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলোও বেসরকারি আইসিডি থেকে খালাসের অনুমোদন দেয়া হয়। ক্রমে চাল ডাল তুলা ছোলা সরিষাসহ মোট ৩৮ ধরনের পণ্য আইসিডি থেকে ডেলিভারি নেয়ার নির্দেশনা জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। উপরোক্ত পণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো বন্দরে জাহাজ থেকে নামানোর পর আইসিডিতে স্থানান্তর করে দেয়া হয়। আমদানিকারক আইসিডি থেকে তাদের পণ্য ডেলিভারি নিয়ে থাকে। এতে বন্দরের অভ্যন্তরে ইয়ার্ডে কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠার প্রবণতা কমে যায়। বন্দরের ভিতরে কন্টেনারের পাহাড় না থাকায় ইকুইপমেন্ট মুভমেন্টসহ সার্বিক কার্যক্রমে গতিশীলতা তৈরি হয়। এতে বন্দরের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। অপরদিকে বেসরকারি আইসিডিগুলোতে কাজের চাপ বাড়ে। বাড়ে ব্যবসা, বাড়ে কাজ। আইসিডিগুলোতে অন্তত বিশ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়।

সূত্র বলেছে, বন্দর থেকে ৩৮ ধরনের পণ্য আইসিডিতে স্থানান্তরিত হওয়ায় বিভিন্নভাবে সুবিধা হলেও মহল বিশেষের আয় রোজগারে অসুবিধা হয়। আমদানিকারকদের কাছ থেকে বন্দর এবং কাস্টমসকে ঘুষ দেয়াসহ নানা খাতে নেয়া টাকাও বন্ধ হয়ে যায়। জাহাজ থেকে নামার পর কন্টেনার আইসিডিতে চলে যায়। আইসিডিতে সংরক্ষিত থাকে। ওখান থেকে বিল পরিশোধ করে ডেলিভারি নেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় আইসিডির নির্দিষ্ট হারের খরচসহ যাবতীয় বিল রশিদ মূলে পরিশোধ করা হয়। এতে নানাখাতের হিডেন বিল নেয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহল বিশেষ পুরো প্রক্রিয়াটির বিরোধীতা করতে থাকে। আর এরই জের ধরে বিগত ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ৩৮ ধরনের পণ্য বন্দর থেকে খালাস করার সুযোগ দিয়ে সার্কুলার জারি করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। ওই সময় থেকে আইসিডিতে আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং এর পরিমান কমতে থাকে। গতকাল এই সুযোগের মেয়াদ আবারো তিন মাস বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের গতকাল জারি করা পত্রটিকে আইসিডি ব্যবসার কফিনে শেষ পেরেক বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বৈশ্বিক সংকটে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য এমনিতে কমে গেছে। ফলে আইসিডিগুলোর কার্যক্রম ২৫ শতাংশ কমে গেছে। এমতাবস্থায় আমদানিকৃত ৩৮ ধরণের পণ্য বোঝাই কন্টেনার আরো তিন মাস বন্দর থেকে ডেলিভারি নেয়ার সুযোগ রাখা হলে আইসিডিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হবে।

বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপোটস এসোসিয়েশন (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান স্বাক্ষরিত কাস্টমস কমিশনার বরাবরে প্রেরিত এক পত্রে ৩৮ ধরণের পণ্য বন্দর থেকে ডেলিভারি দেয়ার সিস্টেম বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। পত্রে বলা হয় যে, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে গতিশীলতা সৃষ্টির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেখানে ৩৮ ধরণের আমদানি পণ্য অফডক হতে ডেলিভারি প্রদানের আদেশ প্রদান করেছে সেখানে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ কেন বারবার এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এতে বিশাল বিনিয়োগে গড়ে উঠা প্রতিটি আইসিডি অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি আমদানি পণ্যবাহী কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তর হতে ডেলিভারি প্রদান করার কারণে বন্দরে কন্টেনার জট এবং রাস্তায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করে বন্দর এবং অফডকগুলোর সার্বিক অপারেশনাল কার্যক্রমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও মন্তব্য করেছেন। অপর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ১৯টি আইসিডির ধারণক্ষমতা ৭৬ হাজার টিইইইএস। এই অবকাঠামো গড়ে তুলতে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এর একটি বড় অংশ ব্যাংক ঋণ।

চট্টগ্রামের আইসিডিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার টিইইউএস কন্টেনার বন্দরে নিয়ে যাওয়া হতো। বর্তমানে তা দেড় হাজারে নেমে এসেছে। নতুন এই নির্দেশে আইসিডিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমান আরো কমে যাবে। আইসিডিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিংসহ সার্বিক কার্যক্রমের জন্য অন্তত বিশ হাজার লোকবল রয়েছে। কাজ কমে যাওয়ায় প্রতিটি আইসিডি থেকে লোকবল কমাতে হবে। বিষয়টি সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের জয়েন্ট কমিশনার মোহাম্মদ তফছির উদ্দিন ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত গতকালের পত্রটির ব্যাপারে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আইসিডিগামী কন্টেনার সময়মতো পরিবহন না হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। আমদানিকারক এবং সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আইসিডির পরিবর্তে বন্দর থেকে কন্টেনার ডেলিভারি দেয়ার দাবি করা হয়েছিল। এতে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস (ব্যবসার ব্যয়) কমে যাবে বলেও কাস্টমস কর্মকর্তারা দাবি করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভবিষ্যতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিন : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধহিম হাওয়ায় বাড়াচ্ছে শীত