পূর্ব প্রকাশিতের পর
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারী পার্টি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পটিয়ায় মরহুম অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে মরহুম সোলতান আহমদ কুসুমপুরীকে মনোনয়ন দেয়। এখানে বিশেষভাবে পটিয়ার একজন ত্যাগী নেতা, সেসময়ের পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সভাপতি মরহুম মোস্তাফিজুর রহমানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। ৭০‘র সাধারণ নির্বাচনের শুরু থেকেই আমরা ছাত্রসমাজ জনগণকে সাথে নিয়ে পটিয়ায় জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের মনোনয়নপ্রাপ্ত নেতাদের পক্ষে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ও প্রচার–প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। পটিয়ায় সেদিন আমরা ছাত্রলীগের শত–শত নেতা–কর্মী উৎসাহের সাথে নির্বাচনী প্রচার কর্মকাণ্ডে নেমে পড়ি। আমরা ছাত্রসমাজ জানতাম, এই সাধারণ নির্বাচন হলো বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি ম্যান্ডেটস্বরূপ। এই ম্যান্ডেট না পেলে স্বাধীনতার ডাক দেওয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হতো না।
উল্লেখ্য যে, ‘বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা কর্মসূচি’ ও ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ প্রচারপত্রগুলো ব্যাপক প্রচারের স্বার্থে আমার হাতে–হাতে রাখতাম সবসময়। ইউনিয়নে, হাটে–বাজারে, রাস্তা–ঘাটে, চলার পথে সমগ্র পটিয়ায় পুস্তিকা ও প্রচারপত্র জনগণের মাঝে বিলি করতাম। উল্লেখ্য যে, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আহমদ নুর ভাই সেই ৭০‘র নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মনোনয়নপ্রাপ্ত অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও প্রাদেশিক পরিষদের সোলতান আহমদ কুসুমপুরীর সাথে নির্বাচনী গাড়িতেই থাকতেন এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনী সভা–সমাবেশে জোরালো প্রচারণামূলক বক্তব্য রাখতেন। মাঝেমধ্যে আমাকেও সঙ্গে রাখতেন। তখনকার সময়ে নির্বাচনী প্রচারকাণ্ডে একটি জনশ্রুতির কথা মনে পড়ে, সেটি হলো ‘বঙ্গবন্ধুর নৌকা প্রতীকের অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও ন্যাপের কুঁড়েঘরের প্রার্থী প্রয়াত পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মধ্যে নির্বাচনী কৌশলগত গোপন সমঝোতার কথা’। তবে আমরা ছাত্রসমাজ তা আমলে না নিয়ে জাতীয় পরিষদের প্রার্থী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং প্রাদেশিক পরিষদে মরহুম সোলতান আহমদ কুসুমপুরীর পক্ষে জোরালো নির্বাচনী প্রচার কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখি। সোলতান আহমদ কুসুমপুরীর নির্বাচনী প্রচার কর্মকাণ্ডে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়ও ছিলাম আমি।
‘৭০–র ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত ৮টা থেকে আমার নিজ গ্রাম, পটিয়ার ছনহরা ইউনিয়নের ‘আলমদারপাড়া‘ গ্রামের মরহুম রেয়াজুদ্দিন শেঠের নতুন বাড়িতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম জহির উদ্দিন আহমদ (এম. কম.)’র সভাপতিত্বে নির্বাচনী বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হতে চলেছিল। তখনকার দিনে মেয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার ব্যাপারটা একটু জটিল ছিল। কারণ, বোরকা পরে আসতে হবে। তাই মেয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করার বেলায় সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীরা সবাই আমার দিকেই চেয়ে রইলো।
নির্বাচনী এই সভায় উপস্থিত ছিলেন মরহুম আলী আকবর, মরহুম এডভোকেট আবদুল গণি, জনাব আবুল কাশেম (ঠাণ্ডা মিয়া), মফজল আহমদ মেম্বার, ধাউরডেঙ্গার মুরারী মোহন বিশ্বাসসহ ইউনিয়নের অনেকে। উপস্থিত সবার উদ্দেশে আমি বলে উঠলাম, ‘আপনারা সভা চালিয়ে যান। আমি সোলতান আহমদ কুসুমপুরীর বাড়িতে যাচ্ছি’। উপস্থিত একজন (নাম মনে পড়ছে না) আমার হাতে ১০টি টাকা দিয়েছিলেন আসা–যাওয়ার সুবিধার্থে। রাত্রে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিলাম।
ছনহরা ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্তে কেরিঞ্জা নামক খাল। এই খালটি পার হতে হবে। ঘাটে ছিল পুরানো ডিঙ্গী নৌকা। নৌকার মাঝি খুবই বয়স্ক ও মাজুর টাইপের ছিল। ইব্রাহীম নামক এই নৌকার মাঝির সাথে পূর্বে থেকেই আমার পরিচয় এবং জানাশোনার সুবাধে সহজেই খাল পার হলাম। তাকে দুইটি টাকা দিয়ে বললাম, ‘কাল ইলেকশন। আমি সোলতান আহমদ কুসুমপুরীর বাড়িতে যাচ্ছি বোরকার জন্য। তোমাকে রাত ৩/৪টার সময় থাকতে হবে’। এটা বলার পর ইব্রাহীম মাঝি বলে উঠলো, ‘ওঁবা আই বেয়াজ্ঞীন জানি, তোঁয়ারেও চিনি। অসুবিধা নাই। আই থাইক্কুম’। উল্লেখ্য, খালের পশ্চিম পাড়ে আশিয়া ইউনিয়ন পেরিয়ে সোলতান আহমদ কুসুমপুরীর বাড়ি। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে কুসুমপুরীর বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৪ মাইলেরও বেশি হবে।
নেতার বাড়িতে পৌঁছলাম। এখানে ভাত খেলাম। ৫০টি বোরকা দিলো, তবে কোন টাকা–পয়সা দিলো না। বোরকার গাইড মাথায় করে পায়ে হেঁটে পুনরায় কেরিঞ্জা খালের পাড়ে পৌঁছামাত্র ঐ নৌকার মাঝি (ইব্রাহীম) বলে উঠলো, ‘ওঁবা আইসসু না, আই তোঁয়ারলাই বই রইদি। আঁরার কুসুমপুরী অই যাইবু’।
ফজরের আজানের কিছু আগে নির্বাচনী সভার স্থলে পৌঁছলাম। সবাই আমার দিকে হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, আর ভাবতে লাগলো, কীভাবে এই কাজ করলাম। সঙ্গে–সঙ্গে বোরকাগুলো ডিস্ট্রিবিউট করা হলো। সকালে ইলেক্শন শুরু হয়ে ৫ টায় শেষ হলো। ভোট গণনায় দেখা গেল, আমার ইউনিয়নের সবকটি সেন্টারে বিপুল ভোটে শতভাগ বঙ্গবন্ধুর নৌকার বিজয় হলো। চারদিকে বিজয় মিছিল। মিছিলের আওয়াজে গোটা ইউনিয়ন প্রকম্পিত। পরে মিছিল সহকারে আমরা পটিয়া সদরে পৌঁছে বৃহত্তর বিজয় মিছিলে শরীক হই। সবকিছু শেষ করে রাত ১২টা–১টার দিকে নিজ বাড়িতে পৌঁছি।
৭০’র সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সারা পাকিস্তান শাসনের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে ক্ষমতা দেওয়া হলো না। ৭১‘র ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ঢাকায়। কিন্তু ১লা মার্চ হঠাৎ ইয়াহিয়া খানের এক ঘোষণায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত করা হলো। বিক্ষোভে ফেটে পড়লো গোটা দেশ। আমরা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা সেদিন তৎক্ষণাৎ পটিয়ায় বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিল শুরু করি। ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ স্লোগানে–মিছিলে পটিয়া প্রতিবাদমুখর ছিলো। এদিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শহর–বন্দর, গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠল। মূলত সেদিন থেকেই বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর হুকুমে।
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তরণের এই পর্যায়ে ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ–সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে গঠিত হলো স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। এ জন্য পরবর্তীতে জনতা এ চার নেতাকে ‘চার খলিফা’ বলে অভিহিত করে। যদিও পরবর্তীতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বক্তব্যের কারণে কেউ–কেউ বিতর্কিত হয়েছেন, যা পীড়াদায়কই বটে।
ঘটনার পরিক্রমায় স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, এবং পরবর্তী রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ৭ই মার্চের ভাষণে মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ে জনসমুদ্র, বাতাসে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা এবং লাখো মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক বাঁশের লাঠি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে–স্লোগানে উদ্দীপ্ত জনসমুদ্র কণ্ঠে তোলে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; ঘরে–ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
এখানে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব শাহীর আমলে ইউনিয়নগুলোতে ১ব্যান্ডের ফিলিপ্স রেডিও ছিলো। আমার আত্মীয় মরহুম মোজাহের চৌধুরীর মাটির দেওয়ালের কাচারিঘরে বসে ঢাকা থেকে প্রচার করা ১৯৭১’র ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অগ্নিঝরা ভাষণটি শুনেছিলাম।
ভাষণ পরবর্তীতে আমরা পটিয়ায় স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তখনকার নিউক্লিয়াসের সদস্য ছাত্রনেতা আহমদ নুরের নেতৃত্বে সমগ্র পটিয়ায় ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে নির্দেশিত কর্মসূচি মোতাবেক সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানাতে থাকি এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন এগিয়ে নিতে আমরা মাঠে ময়দানে রাজপথে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করি।
সারাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে চলছে পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সকল কর্মসূচি চট্টগ্রামে ও পটিয়ায় আমরা মুহূর্তে–মুহূর্তে অবহিত হতাম। আমাদের ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে হরতালে, আন্দোলনে, সংগ্রামে–মিছিলে একাকার ছিল সমগ্র পটিয়ার জনপদ। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম শহরে বড় মিছিলে যোগ দিতেও চলে যেতাম।
মনে পড়ে ১৫ই মার্চের কথা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানায় নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান। এ সময় পুরো ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। আমরা এখবর চট্টগ্রামে ও পটিয়ায় পাওয়ামাত্র ইয়াহিয়া, ভুট্টো, টিক্কার বিরূদ্ধে মিছিল শুরু করি। গাড়িতে, যানবাহনে কালো পতাকা লাগাতে বাধ্য করি। ঢাকায় সরকারি–বেসরকারি ভবনে ও যানবাহনে, সর্বত্র সেদিন কালো পতাকা উড়েছিলো। বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল থেকে নতুন সামরিক ফরমান জারির প্রতিবাদ এবং বাংলাদেশ রক্ষায় সব নাগরিককে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে ১৯৭১‘র ২৫শে মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর চরম বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে, তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্তে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠান ওয়ারলেসে। ওয়ারলেসে পাঠানো বার্তাটি চট্টগ্রামে পৌঁছামাত্র জহুর আহমদ চৌধুরীর হাতে পৌঁছানো হয়েছিল এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. হান্নানসহ আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের নেতারা স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করেছিলেন।
লেখক: ষাট দশকের ছাত্রনেতা।