ষাট দশকের ছাত্র-আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

মুহাম্মদ তাহের আলমদার | শনিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল ‘শিক্ষা সংকোচন নীতি’র বিরুদ্ধে সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসাবে প্রথম শিক্ষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। সেই ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সাল।

পটিয়াস্থ ভাটিখাইননলিনীকান্ত মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটে সবেমাত্র ষষ্ঠ থেকে সপ্তমে উঠেছি। সকাল ১১টায় ক্লাস চলাকালীন হঠাৎ স্লোগানেস্লোগানে ছাত্রমিছিল স্কুল মাঠে প্রবেশ করে। স্লোগানের তীব্রতা এতোবেশি ছিলো, যেন পুরো স্কুল মাঠ প্রকম্পিত হচ্ছিলো। মিছিল থেকে সবাইকে হরতালে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এসময় স্লোগানের ভাষা ছিল, ‘আইয়ুব শাহীর কোনও আইন মানি না মানব না। গণবিরোধী শিক্ষা সংকোচন নীতি বাতিল করো, করতে হবে।’

এরপর আমরা ক্রমশ সবাই মিছিলে শামিল হই। মিছিল পটিয়া সদরে পৌঁছালে তৎকালীন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, অনলবর্ষী বক্তা আহমদ নূরের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে রাজপথ প্রকম্পিত করে আমরা সম্মুখদিকে এগিয়ে যাই। তখন আরাকান সড়কে চক্রশালা হাই স্কুল ও মোজাফ্‌রাবাদ হাইস্কুলের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢালাই কার্পেটিং শেষ হওয়ায় মিনিবাস ও বিভিন্ন যানবাহনে করে চক্রশালা হাই ও মোজাফরাবাদ হাই স্কুলস্ট্রাইক করে বর্তমান বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এগিয়ে যাই। আরাকান সড়কের এই অংশে নতুন ইট বিছানো, কংকর, বালি, সিমেন্ট এর কাজ চলছে। সামনে দেখলামইক্ষু (কুইশ্যাল) বোঝাই করা একটি ঠেলাগাড়ি খুব কষ্ট করে সড়কের প্রতিকূল অবস্থা পার করে সামনে আসামাত্র ছাত্রমিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা সবাই জোরপূর্বক সব ইক্ষু খেয়ে ফেলে। ঐ দিন ছিল সোমবার।

দোহাজারী থেকে এই ইক্ষুগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে ঠেলাগাড়িওয়ালা পটিয়া থানা হাটে নিয়ে আনছিল। সব ইক্ষু হারিয়ে বেচারা ঠেলাগাড়িওয়ালা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। তার এই অবস্থা দেখে আমরা ছাত্রআন্দোলনের সবাই দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, এক আনা, দুই আনা, করেকরে ইক্ষুর মালিক ঠেলাগাড়িওয়ালাকে দেওয়া শুরু করলাম। সবশেষে হিসাব করে দেখা গেলো, সে এই ইক্ষুগুলো বিক্রি করে যা পেত, তারচেয়ে দ্বিগুণ তার লাভ করে নিলো। এতে সে সীমাহীন খুশি হয়ে তার বাড়িতে চলে যায়। সড়কের কংকর, বালি, সিমেন্ট পরিবহনকারী ট্রাকগুলো বোঝাই নামিয়ে দিয়ে খালি পড়ে থাকায় আমরা সেই সব গাড়িতে করে হাশিমপুর, গাছবাড়িয়া স্কুলসহ এসমস্ত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্ট্রাইক করে দোহাজারী হাই স্কুল মাঠে সমবেত হই।

উল্লেখ্য যে, শিক্ষা দিবসের এই ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে তখনকার দিনের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা মৃত অনিল লালা, (গৈড়লা, পটিয়া), মরহুম আফজল আহমদ, (হাজীর পাড়া, পটিয়া), মুহাম্মদ শাহজাহান (মুন্সেফ বাজার, পটিয়া), মরহুম চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ (মুহাম্মদ নগর) মুহাম্মদ শামসুদ্দিন (সুচক্রদণ্ডী, পটিয়া), কাজী আবু তৈয়ব (কাগজী পাড়া, আল্লাই, পটিয়া) সহ নাম না জানা অনেকে ছিলেন।

দোহাজারী হাই স্কুল মাঠে সমবেত বিশাল ছাত্রসমাবেশে ছাত্রনেতাদের বক্তব্যের পর আমরা আন্দোলকারী ছাত্ররা সবাই একই কায়দায় পায়ে হেঁটে, বা গাড়িতে করে পুনরায় পটিয়া সদরে পৌঁছি। এরপর থেকে স্কুলের লেখাপড়া, ক্লাস করার পাশাপাশি যখনি শিক্ষা আন্দোলনের হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা হতো, তখন সাথে সাথেই আমরা ক্লাস বন্ধ করে মিছিলের সাথে পটিয়া সদরের ছমদ চত্বর তথা থানার মোড়ে পৌঁছে যেতাম।

ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ সকলস্তরের ছাত্রসমাজ এই থানার মোড়ে সমবেত হতাম এবং এখান থেকেই ঐক্যবদ্ধ ছাত্রআন্দোলন শুরু হয়ে ছড়িয়ে যেত। আন্দোলনে, স্লোগানে পটিয়ার রাজপথ প্রকম্পিত হতো। মুখে মুখে অনুরণিত হতো, ‘আইয়ুব শাহীর কোনো আইন মানি না মানবো না; গণবিরোধী শিক্ষাসংকোচন নীতি বাতিল কর, করতে হবে’। এভাবে পটিয়ায় শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীতে ছাত্রআন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। যখনি ডাক পড়ে, তখনি আমরা রাজপথে, এসবই তখন আমাদের নিয়মে পরিণত হয়েছিল।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৬২ সালে প্রথমে কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং পরে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামিদুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করা হয়। এটিই কুখ্যাত ‘হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ নামে পরিচিত। এই কমিশন যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ গণবিরোধী। এরই মধ্যে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফা পেশ করেন বঙ্গবন্ধু। ছয় দফার যৌক্তিকতা ও জনমত গড়ে তুলতে দেশব্যাপী জনসভা করার কর্মসূচির অংশ হিসাবে ২৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার সমর্থনে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, চট্টল শার্দুল, এক দফার প্রবক্তা মরহুম এম. . আজিজের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম প্রকাশ্যে জনসভা করেন।

ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী। সে সভায় এম. এ আজিজ ঘোষণা করেন যে, ‘ছয় দফা না মানলে এক দফা স্বাধীনতার আন্দোলন চলবে’। আমার বড় সৌভাগ্য যে, বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ ঐতিহাসিক জনসভায় ছাত্র হিসেবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হলেও উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য’।

চট্টগ্রামের আরেক কীর্তিমান পুরুষ মরহুম ইদরিস আলম রচিত ‘বাঙ্গালীর মুক্তি সনদ ছয় দফা কমসূচি’ সম্বলিত ছোট আকারের পুস্তিকা ও বহুল প্রচারিত ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ প্রচারপত্র হাতে নিয়ে সমগ্র পটিয়া ও রাজপথে (ঘৃণ্য শিক্ষা নীতিসহ) ব্যাপক প্রচারপত্র বিলিসহ ও আন্দোলন সংগ্রামে সবসময়ই থাকতাম। অব্যাহত আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৯ এর ৪ জানুয়ারি ডাকসুসহ চারটি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ছাত্রসমাজের ১১ দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ।

ডাকসু ভিপি হিসাবে সেদিন তোফায়েল আহমদ ছিলেন আহ্বায়ক ও মুখপাত্র। এদিকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম এস এম ইউসুফ ও ছাত্রনেতা, নিউক্লিয়াস সদস্য, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক, আহমদ নুরের নেতৃত্বে পটিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার আন্দোলন আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠে। সেদিন থেকে পটিয়ায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে আমরা ছাত্রসমাজ সারা পটিয়ায় রাজপথে আন্দোলনসংগ্রামে মিছিলে স্লোগানে আমাদের অবস্থান অব্যাহত রাখি।

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ৬৯র গণআন্দোলন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এই ৬৯এ শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ এবং বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জাতির মুক্তি সনদ ছয় দফা বাস্তবায়নকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে আগরতলা মামলা রজু করা হয়। এদিকে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি তুমুল আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দানে বাধ্য করাসহ সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।

২০ জানুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনে আত্মহুতি দিয়েছেন সময়ের সাহসী সন্তান শহীদ আসাদ। উনসত্তরে শহীদ আসাদের রক্তে গড়ে উঠা আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এই গণঅভ্যুত্থানে অগ্নিঝরা রাজপথ রাঙানো আন্দোলনসংগ্রামে পটিয়ার রাজপথে আমাদের মাঝে শরিক থাকতেন সেই প্রখ্যাত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা, চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইউসুফ, আন্দোলনসংগ্রাম ও মিছিলের প্রারম্ভে ইউসুফ ভাইয়ের বজ্রকঠিন বক্তব্যে বলে উঠতেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই; নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। এভাবে পটিয়ায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে মিছিলস্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হতো। অবশ্য ইউসুফ ভাই কেন্দ্রীয় দায়িত্বের কর্মসূচি মোতাবেক পটিয়ার আন্দোলন সংগ্রামে শরিক থাকতেন।

এদিকে সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আমাদের সেই সময়ের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা আহমদ নুর ভাইয়ের নেতৃত্বে পটিয়ায় সফল গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, পাকিস্তানের লৌহমানবখ্যাত কথিত ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খানের পদত্যাগ, ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর পরবর্তী ৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা পর্যন্ত আমরা পটিয়ায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা রাজপথে থেকে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলাম।

(চলবে)

লেখক : ষাট দশকের ছাত্রনেতা

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাই আদর্শ বাবা-মা
পরবর্তী নিবন্ধনতুন চট্টগ্রামকে দেখবে বিশ্বের মানুষ : চাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা