ষাট সত্তর আশির অগ্নিঝরা তিন দশক ছিল এক কথায় স্বপ্নের। গরীব মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্নের। সমাজ ও রাষ্ট্র ভেঙে চুরে শ্রেণিহীন নতুন মার্ক্সবাদী ব্যবস্থা বিনির্মাণের উচ্চাভিলাষী স্বপ্নের। এটি দু’বঙ্গেই সমতালে ক্রিয়াশীল ছিল। দু’বঙ্গের মধ্যবিত্ত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর হল। রাজনৈতিক সংগ্রামে পূর্ব–বাংলার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। পশ্চিম বঙ্গে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক পথে সমাজ বিপ্লব। সিপিআই (মস্কোপন্থী) অংশ এগোল বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে মহাকরণ দখল আর সিপিএম (চীনপন্থী) ও চারু মজুমদার অংশটি চাইল শ্রেণিশত্রু খতম করে সশস্ত্র পথে মহাকরণ দখল।
পূর্ব–বাংলার উচ্চ বিত্ত শ্রেণি বলতে ছিল শতকরা নব্বুই ভাগ হিন্দু জমিদার, হিন্দু ব্যবসায়ী, হিন্দু মহাজন। পূর্ব–পাকিস্তানের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ প্রায় পুরোটাই ছিল হিন্দুদের দখলে। দেশ ভাগের ধাক্কায় ১৯৪৭ এ হিন্দু জমিদার ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার মহাজনদের অব্যাহত দেশত্যাগ চলতেই থাকল। ১৯৬০ সালের দিকে এসে দেখলাম সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, রায় চৌধুরী, ব্যানার্জী, গঙ্গোপাধ্যায় বলতে প্রায় সবাই চৌদ্দপুরুষের ঘরবাড়ীর দরজা খোলা রেখে, পুকুর, ধানের জমি, ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান ফেলে রেখে চলে গেলেন চোখের জল মুছতে মুছতে। রাজনৈতিক বাস্তবতা উপনীত হলো নতুন সমীকরণে। চল্লিশের দশক থেকে শতকরা নব্বুই ভাগ কমরেড ছিলেন হিন্দু। উদ্বাস্তু জনস্রোতে হিন্দু কমরেডদের প্রায় সবাই চলে গেলেন পশ্চিম বঙ্গে তথা ভারতবর্ষে। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না বলে একটা প্রবাদ আছে। আমি সেটার সাথে একমত নই। পৃথিবীর বহুদেশে নব্বুইয়ের দশকে যে’ই বামপন্থী শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা আজো পূরণ হয়নি। এই শতাব্দীতে পূরণ হবার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ।
ঘরের কথায় ফিরে আসি। ষাটের দশকের মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি এগিয়ে এল। মুনীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দীন উমর, তাজউদ্দীন আহমেদ সহ একঝাঁক শিক্ষিত যুবক (বেশিরভাগ মুসলিম) হয়ে উঠলেন প্রাণ পুরুষ। কমিউনিস্ট পার্টিকে পাক সরকার নিষিদ্ধ করায় ৩টি ফ্রন্টে তরুণ কমরেডরা স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনে সক্রীয় হয়ে উঠলেন। তাজউদ্দীন আহমেদ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে অন্তত ৫০ জন নির্বাচিত হয়েছেন যারা আসলে নিষিদ্ধ কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হয়েছেন। এদের মধ্যে তাজউদ্দীনের পর নামকরা ব্যক্তি ছিলেন মহিউদ্দীন আহমেদ।
মস্কোপন্থী কমিউনিষ্টদের বড় অংশটি সক্রিয় থেকেছে ন্যাপ (মোজাফফর) এ। এই দলটি ১৬ ডিসেম্বর ৭১ পর্যন্ত অব্যাহত সমর্থন দিয়েছে প্রবাসী সরকারকে। ন্যাপ, সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নের আলাদা গেরিলা গ্রুপও যুদ্ধকালীন বীরত্বের অংশীদার। ন্যাপ (ভাসানীর) নেতা কর্মীরা ১৯৬৬ সালে বিভক্তির পর পিকিংপন্থী হিসেবে যুব সমাজের একটি বড় অংশকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। প্রবাসী সরকারে ভাসানী সাহেব উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বহু অনুসারী বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ভাসানীর ধানের শীষ মার্কা ও নেতা কর্মীদের বড় একটি অংশ নিয়ে জেনারেল জিয়া গঠন করেন ইঘচ। বদরুদ্দীন উমর, তোয়াহা, দেবেন শিকদার, সিরাজ সিকদারদের দেশপ্রেম এবং মুক্তির আকাঙ্খা ছিল প্রশ্নাতীত কিন্তু তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ কনসেপ্টে বিশ্বাস করতেন না। এজন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি।
ষাটের দশকে তরুণ প্রজন্ম পুরো জনপদ কাঁপিয়েছে মূলত শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী ও কমরেড মনি সিংহ এর নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা স্বায়ত্বশাসনের স্লোগানের আড়ালে এগিয়েছেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। তাঁকে ঘিরে মধ্যবিত্ত এই তরুণ সমাজ ধরে নিয়েছিল যদি দেশ স্বাধীন করা যায় তবে পাকিস্তানী তাড়িয়ে তারাই হবেন সমস্ত কলকারখানার মালিক। আসলে ঘটেছিল তাই’ই। স্বাধীনতার পর আওয়ামী রাজনীতিক, শ্রমিক নেতা ঠিকাদারদের লুটপাটের মাত্রা চূড়ান্ত সীমারেখা অতিক্রম করেছিল। যন্ত্রপাতি খুলে বিক্রি করার উদাহরণ যেমন ছিল তেমনি ছিল ব্যাংক লুটপাটের নির্মম কাহিনি। সত্তর ও আশির দশকে এসে শাসক শ্রেণি, সরকারি মিল কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় উঠতি বুর্জোয়াদের চাপে।
ষাটের দশকে ছাত্র নেতৃত্ব স্বায়ত্বশাসন আন্দোলন এগিয়ে নিলেও শ্রমিক শ্রেণি রাজনীতি প্রবণ হয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্ম। ছাত্রলীগের একটি বড় অংশ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সমাজতন্ত্রের বক্তব্য নিয়ে ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করে। সচেতন মানুষ মাত্রই জানতেন গণসংগঠন নামাঙ্কিত ছাত্র ইউনিয়ন আসলে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখা মাত্র। ৬ দফার মধ্যে সমাজতন্ত্রের একটি কথাও ছিল না। কিন্তু ৬৯ এর গণঅভুত্থানের পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রদের প্রণীত ১১ দফার ৫টি ছিল সমাজতান্ত্রিক ঘরানার শ্রমিক ও শিক্ষা নীতি সম্পর্কিত।
দেশতো স্বাধীন হলো। ক্ষমতা কুক্ষিগত করলো আওয়ামী উঠতি বুর্জোয়ারা। বিদায়ী যৌবনের যুবকরা সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর হলেন। জাসদের ও সিরাজ শিকদারদের, শ্রমিক কৃষক দেখলেই মনে করতো এরা মনুষ্য নয় দেবতা। তাদের মুক্তিদাতা। আজ সে’ই মস্কোপন্থী বলুন আর পিকিংপন্থী বলুন এককথায় সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন কেউ দেখে না। বাকশাল ছিল বঙ্গবন্ধুর সমাজ বিপ্লবের মৌলিক স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রথমবার এই বিপ্লবী স্বপ্নের মৃত্যু হল। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার চীনপন্থী বিপ্লবী স্বপ্নের মৃত্যু হল। সিরাজ সিকদারের ক্রসফায়ার বঙ্গবন্ধু ও এসপি মাহাবুবকে ইতিহাস চিরকাল প্রশ্ন করবে। জাসদের বীরোত্তম কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে বিপ্লব করলেন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫। হত্যা করলেন ক্ষণস্থায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফকে। ২১ জুলাই ১৯৭৬ ফাঁসিতে ঝুলানো হলো পঙ্গু তাহেরকে। তৃতীয় ও শেষ বিপ্লবী স্বপ্নের এখানেই আপাত সমাপ্তি।
অনেকে ইদানীং বলছেন দেশ দ্রুত রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটারও মূল কারণ বাম রাজনীতির বিপর্যয়। নতুন প্রজন্ম আজ আর বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে না। মুক্তবুদ্ধি বিকাশের স্বপ্ন দেখে না। আর ষাটের দশকে আহসান উল্লাহ চৌধুরী এর মতো যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল তারাও একে একে চলে যাচ্ছেন ব্যর্থতার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। এরপরও আগামী প্রজন্ম দেখবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে সমাজ বিপ্লবের অবধারিত মহা আয়োজন।
লেখক: আইনজীবী, আপিল বিভাগ।









