(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর হেডমাস্টরখ্যাত শিল্পী সিরাজুল ইসলাম আজাদের গাওয়া আটটি গান গোটা চট্টগ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর ‘পাষাণ দরিয়া’ নামক ক্যাসেটটি চট্টগ্রামের অডিও ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত ক্যাসেট। সিরাজের গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে। নিচের গানটি এখনো উপকূলীয় এলাকার মানুষকে কাঁদায়।
‘মারে বেইল ত ভাতর অত্ত অইয়ে
আঁরে দঅনা ভাত
গুরা পোয়ায় কাঁদি কাঁদি কঅর
ধরি মরা মায়ের হাত
মারে আঁরে দঅনা ভাত।
(জীবনগীত সম্পাদনা : অধ্যাপক ড. শেখ সাদী)
এবার আসা যাক ‘আঞ্চলিক গানে বরষার বিরহ আর শরতের সাদা কষ্ট’ প্রসঙ্গে।
‘ঝর পরেদ্দে লোচা রে লোচা’ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত একটি প্রাচীন লোকগীতি। গানটি শতবর্ষ আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকগবেষক আশুতোষ চৌধুরী চট্টগ্রামের কোন একটি অঞ্চলের লোকমুখ থেকে সংগ্রহ করেন। এটি পরবর্তীতে সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী রচিত ‘আমিনা সুন্দরী’ নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে। এই গানের আরেকটি ভার্সন প্রচলিত, যেমন
ঝর পরেদ্দে লোচা লোচা
উডানঘাড়া পানি
এন সমত আজরাইল আইব
আঁইত ন জানি।
মেঘ রাজার ৭ কন্যার বিয়ে নিয়ে সঙ্গীতজ্ঞ সিরাজুল ইসলাম আজাদের অপূর্ব একটি গান আছে। প্রায় ৪০ বছর আগে কক্সবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন মঞ্চে গানটি গেয়েছেন তিনি। গানটি এরকম…
আইস্যেরে আষাঢ় মাস
আসমান মাতের গুজুরি
মেঘ রাজার সাত কইন্যা
যাইব শ্বশুরবাড়ি।
(ক্যাসেট থেকে সংগৃহীত)
তবে চাঁটগাইয়া গানে বর্ষার আনন্দের চেয়ে দুঃখকষ্ট বেশি চিত্রিত হয়েছে। কারণ ঘনঘোর বর্ষা নিয়ে আসে বন্যা। চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে ‘আশ্বিনের চিয়ন রাট’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে, উত্তরাঞ্চলে যেটিকে বলা হয় মঙ্গা। ছোটবেলায় দেখেছি জৈষ্ঠ মাসে গ্রামের গরিব পরিবারের বয়সী নারীরা কিছু ধান আলাদা করে ডোলে (ধান রাখার বিশেষ গোলা) লুকিয়ে রাখতেন। এসব ধান আশ্বিনের মঙ্গার জন্য তুলে রাখা হতো। আগেকার দিনে ভাদ্রআশ্বিনে গ্রামের মানুষের হাতে তেমন কাজ থাকত না। চালডালসহ নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে যেত। সেই কঠিন অভাবের দিনে দরিদ্র মানুষ অনাহারে অনাহারে দিন কাটাতেন। আগস্ট থেকে শুরু হওয়া অভাব থাকতো আশ্বিনকার্তিক পর্যন্ত। অগ্রহায়নে ধান কাটা শুরু হলে অভাব ধীরে ধীরে কমতো। এই মঙ্গা নিয়ে কবিয়াল রমেশ শীলের গানটি এমন…
রস্যার বাপরে, রস্যার বাপ
উপায় কি রস্যার বাপ
বুদ্ধি দেয় ভাই কোন প্রকারে
এবার জান বাঁচাই।
একে ত বরিষা কাল
দারুণ আষাঢ় মাস,
পেয়াছা লই হইলাম
তিন অত্তর উয়াস।
পোয়া দুয়া মাইয়া ওগ্গা,
কাঁদি অই যার খুন
ঘরত নাই এক দানা চইল,
ভাত দিয়ম কত্তুন।
বিষ পাইতাম বিষ খাইতাম
ও ভাই বিষ কিনিবার পয়সা নাই।।
১৯৬০সালের ১০ জুলাই রচিত কবিয়াল রমেশ শীলের এই গানে তখন বর্ষা মৌসুমে সাধারণ মানুষ কী দুর্বিষহ অভাবে দিন কাটাতেন তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৯৪৪ সালের ৭ অক্টোবর রচিত কবিয়াল রমেশ শীলের আরেকটি গান আরও করুণ।
দেশের বন্ধু ভাই, দেশী লোকের
প্রাণ রাখ বাঁচাই,
সংকটের উপর সংকট
এবার বুঝি রক্ষা নাই।
গত সন আষাঢ় শ্রাবণে
কি আগুন যে জ্বলেছে
দুই লক্ষ নরনারী
চট্টগ্রামে মরেছে।
(রমেশ শীল রচনবালী : সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ)
স্পষ্ট বোঝা যায়, আলোচ্য গানে ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের কথাই উল্লেখ করেছেন কবিয়াল রমেশ শীল।
চট্টগ্রামে সাধারণত শীতগ্রীষ্ম (পৌষ–বৈশাখ) মিলে যে কাল সেটাকে ‘হুদিন’ বা ‘সুদিন’ আর বর্ষা থেকে শরত (জৈষ্ঠ্য–কার্তিক) পর্যন্ত সময়কে ‘বারিষা’ বলা হয়। চাটগাঁইয়া গানের কিংবদন্তী আব্দুল গফুর আলীর একটি মরমী গানে ‘হুদিন–বারিষা’ এসেছে জীবনমৃত্যুর অনুপম অনুষঙ্গ হিসাবে। গানটি এমন–
দেহ ছাড়ি প্রাণ গেলে রে
আর কন দিন ফিরি আইসত নয়,
ওরে জোড়র কইতর বেজোড় অইলেরে মন
আর কন দিন জোড় পুরাইত নয়।।
বেরাইবাল্লাই গরবা আইলেরে
(ও মন) থাকে আর ক’দিন,
বর্ষা কাইল্যা নদীরে শুকাই আইলের হুদিন।
ওরে ভাডার পর জোয়ার আইয়েরে মন
জোয়ার গেলে আবার ভাডা হয়।।
শুরু করেছিলাম বর্ষার বিরহ দিয়ে, শেষ করি বর্ষা নিয়ে রচিত মনমাতানো একটি পাহাড়ি গান দিয়ে।
বাঘাইছড়ির মারিশ্যা গ্রাম। পাহাড়–কোলে হ্রদ। সেই গ্রামেরই কিশোর অমর শান্তি চাকমা। পড়ে মারিশ্যা উচ্চবিদ্যালয়ে। একদিন বাবার সঙ্গে নৌকায় চড়ে পাশের গ্রাম থেকে ধান আনতে যায় অমর। ছেলেকে নৌকায় বসিয়ে পাড়ায় ঢুকে পড়েন বাবা। তখন আষাঢ় মাস, বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর হ্রদ। নতুন পানি পেয়ে আনন্দে লাফালাফি করছে মাছের দল। পানির ওপর উড়ছে পাখিরা। তার ওপরে নীল আকাশে ভাসছে মেঘের ভেলা। দৃশ্যটা কিশোর অমর শান্তি চাকমার মন ছুঁয়ে গেল। আর তখনই তার পরাণের গহীন থেকে উঠে এলো দুটি পঙতি,
‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে মেঘলু দেবাত তগে
ম পরন্নান যেদ মাগে তারার লগে লগে।’
(উড়ছে পাখি মেঘে মেঘে মেঘলা আকাশের নিচে/মন আমার যেতে চায় তাদের সাথে সাথে)।
এর কিছুদিন পর মারিশ্যা উচ্চবিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইতে এলো রাঙামাটির ক্ষুদে শিল্পী, স্কুল শিক্ষার্থী রণজিৎ দেওয়ান। গান শেষে রণজিৎ দেওয়ানের কাছে ছুটে গেল অমর শান্তি। পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা ছোট কাগজ বের করল। সেই কাগজে কাঁচা হাতে লেখা একটি গান, ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে…’। গানটি সুর দিয়ে গাইবার জন্য রণজিৎকে অনুরোধ করল অমর। গানটি বেশ পছন্দ হলো রণজিতেরও। পাহাড়ের কথা, পাহাড়ি মানুষের কথা, হ্রদের কথা এত সুন্দর করে এত সহজ ভাষায় আগে তো কেউ লিখেনি! রণজিৎ দেওয়ান গানটি কণ্ঠে তুলে নিল। এক কিশোর গীতিকারের গানে সুর দিল আরেক কিশোর। রাঙামাটি ফিরে গানটি মঞ্চে গাইতে লাগল রণজিৎ দেওয়ান। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল গানটি-‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে মেঘলু দেবাত তগে’। পাহাড়ি গানে এলো নতুন জোয়ার। পরে গানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সারা দেশে তুমুল জনপ্রিয় হলো।
চাকমা ভাষা ঠিক চট্টগ্রামী ভাষা নয়, তবে চট্টগ্রামী ভাষার দূর সম্পর্কের সহোদর বলা যায়। চাকমা–মারমা ভাষার সাথে চট্টগ্রামী ভাষার অনেক মিল আছে। সেই হিসাবে ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে মেঘলু দেবাত তগে’ গানটিও সমতলের মানুষকে আকুল করে, যেভাবে আকুল করে সেই আঞ্চলিক গান…
ঝর পরেদ্দে লোচা রে লোচা
উজান উডের কই
এন বরিষার কালে থাইক্কুম কারে লই।
ই–মেইল: nuhaider@gmail.com