শ. ম. বখতিয়ার : সমাজমনস্ক জীবনবাদী এক কবিকণ্ঠ

রিজোয়ান মাহমুদ | রবিবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ৪:৪৯ পূর্বাহ্ণ

কবি শ.. বখতিয়ার, ভীষণ স্পষ্টবাদী সত্য সুন্দর এক নির্ভীক মানুষ। মুখের উপর সত্য উচ্চারণে কখনোই পিছপা হন না। তাঁর লড়াই ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। জীবন ও জীবিকার সাথে লড়াই করে আজকের অবস্থানে আসা খুব সহজ ছিল না । তিনি ভালো করে বোঝেন জীবনের আটঘাট ও অন্ধিসন্ধি। কঠোর পরিশ্রম আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে এখনকার সময়ে সমাজের প্রথম কাতারে থাকা প্রিয় মানুষ আমাদের বখতিয়ার ভাই। বিপদগ্রস্ত কিংবা না খেতে পাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো তাঁর একটা সহজাত প্রবৃত্তি। মানবিক ঔদার্যবোধ এবং নমনীয়তা অনেক মহৎ ও সুন্দর করেছে মানুষটিকে। সামাজিক বিভিন্ন মানবিক কর্মযজ্ঞে উপস্থিতি থাকা তাঁর আরাধনার অংশ। সেই নিয়মানুসারে তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) চট্টগ্রাম, চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক। শিশু মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন ও পরামর্শ কেন্দ্র হেলথ পার্ক এর প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা। সবচেয়ে আকর্ষণযুক্ত, তিনি বাড়ির পাশের ঐতিহ্যবাহী মুন্সিপুকুর রক্ষা করেছেন ভরাটের হাত থেকে। যে পুকুর সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। নগরীর প্রত্যন্ত অঞ্চল এরইমধ্যে যেখানে পুকুর শূন্য হয়ে গেছে। সেখানে কালের সাক্ষী বহন করা এই পুকুরটি রক্ষা পেয়েছে। দুঃসাহসিক কাজ বটে। কবি বলেই হয়তো সম্ভব হয়েছে।

সব বহিঃস্থ পরিচয়ের বাহিরে তিনি এই সমাজ ভূখণ্ডের কবি। আশির দশকে তার লেখালেখি শুরু। মাঝের অর্ধদশক তিনি লেখালেখি থেকে দূরে থাকলেও এখন আবার দুর্দান্ত সরব । তারই ফলস্বরূপ গেল দুবছর পূর্বে প্রকাশিত হলো কাব্যগ্রন্থ : ‘কাচভাঙা জলকণা’। এই কবিতা গ্রন্থে আছে মানুষের ব্যাকুল ব্যাকরণ। আশানিরাশা দুঃখবেদনা, দ্রোহ ও পচন ধরা সমাজ মানসের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট। বিষয় ও বুননকৌশল নির্মাণে প্রতিটি কবিতায় অসামান্য একটা বিষয়কে স্পষ্ট করা হয়েছে তা হলো অনবদ্য কাব্যবোধে সমাজ মনস্কতা। প্রতিটি কবিতা ছন্দ ও মাত্রাজ্ঞান সম্পন্ন। তিনি এবড়োখেবড়োভাবে কবিতা করতে চান নি। সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক বিকাশে কবিতাগুলো বহন করছে ভিন্ন মাত্রিক নানাবিধ সৌন্দর্য এবং সমকালীন বেদনাবিধুর গল্প। অতীত ও সমকালের দৃষ্টিভঙ্গির সুরে ও স্বরে পাঠক ইতিহাস ঐতিহ্যের মুগ্ধ ঘ্রাণ পাবে।

খুব স্বাচ্ছন্দ্যে সম্ভোগে জীবন বিষয়ক কবিতায় তিনি বিকশিত। সব কবিতাগুলো পরিপূর্ণ রূপক অলংকারে সমৃদ্ধ। সাবলীল বাংলা ভাষ্য অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা আছে বইটিতে। ছন্দ প্রকরণে দুইতৃতীয়াংশেরও বেশি কবিতা অক্ষরবৃত্তে। অল্পসংখ্যক কবিতা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখার চেষ্টা। শব্দ ও শব্দবন্ধের জন্য অভিধানে যেতে হয় না। প্রায়শই শুরুটা গল্পের ভঙ্গিতে বলা। এই সহজিয়া জীবনবোধের গভীরতা এসেছে সাধারণ মানুষের নৈকট্য লাভের গুণে।

. ম বখতিয়ার, জগৎ ও জীবনের কবি। তাঁর দর্শন মানুষকে অনিবার ভালোবাসা যা হবে নিঃস্বার্থ শক্তিমান ও শুভেচ্ছা সুন্দর। আবার তাকে সাবলীল আরক্তমুখের কবি বল্লেও অত্যুক্তি হয় না।

একসময় হঠাৎ তিনি কবিতা থেকে নোটিশ বিহীন ছিটকে পড়েন। বেশ কবছর তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতি কবি আড্ডায় ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কবিতাকে তিনি জোরপূর্বক তালাক দিতে চাইলেও শব্দের দেনমোহর ধরে রাখার কারণে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এতো লম্বা বিচ্ছেদেও কাব্যদেবী তাঁকে ছেড়ে যায়নি একেবারে। বখতিয়ার সে সময় পঙক্তি নির্মাণে এগিয়ে না এলেও কবিতা সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় একধাপ এগিয়েছিল। তাঁর ভরাট কণ্ঠের মুগ্ধ উচ্চারণ অনুষ্ঠানগুলো প্রাণ ফিরে পেত। বখতিয়ারের রূপশালী সাধুসঙ্গ ছিলো ভিন্ন আমেজের। কোভিড পরিস্থিতিতে দেশ হঠাৎ বেসামাল হতে থাকলে বখতিয়ার শব্দগুলো নিয়ে জেগে ওঠেন। আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের সুতো সেলাই মেশিনে নেমে এলে ধীরে ধীরে শব্দ ও অনুভবের সাক্ষ্য হয়ে ওঠেন তিনি।

) ‘যদি ঘুম ভাঙে চেয়ে দেখো,

গাজার ঐ শিশুটির বুকে

ফুটন্ত ভিসুভিয়াস’

) ‘কুকুরের চোখে পর্দা নেই,

অন্ধকারে সব দেখে

অন্ধকারে যদি মানুষ দেখতে পেতো।’

) ‘দেখো এই যে কলম, ছত্রিশ বছর

কত শিষ্ট অশিষ্ট মানুষ বানিয়েছি

এই কলম আমার জীবনের পরম আরাধ্য’

এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় বখতিয়ার এর কবিতায়। প্রথম কবিতার সেন্ট্রাল থিম মধ্যপ্রাচ্যে, ফিলিস্তিন, গাজায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মদদপুষ্ট ইজরাইলের আগ্রাসন। সেখানে নির্বিবাদে মুসলিম গণহত্যা চলছে। বিশ্বের ভেটো রাষ্ট্রের প্রথম সারির নেতারা নিরব ভূমিকায় সব সময়। কবি, ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী শিশুদের বুকের মধ্যে ফুটন্ত ভিসুভিয়াস দেখতে পাচ্ছে।

দ্বিতীয় কবিতায়; কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী। কুকুরের ইন্দ্রিয় ঘ্রাণ ভীষণ তীব্র। কুকুর অন্ধাকারের পাহারাদার। অন্ধকারে দেখে বলে সে কুকুর। আমাদের মায়েরা মধ্য রাত ও শেষ রাতে কুকুরের ঘেউঘেউ অথবা কান্দন শুনলে গৃহস্তের অকল্যাণ টের পেতেন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভদ্রবেশী মানুষের মধ্যে একেকটি কুকুর বসে থাকতে দেখেছেন। ভদ্রবংশীয় লেবাসধারী মানুষের মধ্যে ভয়ংকর কুকুরের বসবাস, যা সচারাচর দেখা যায়না। কিন্তু গভীর পরখ করলে বোঝা যায় ভয়ংকরী স্বভাব। মানুষ যদি কুকুরের মতো অন্ধকারে দেখতে পেত তাহলে বোধ করি অন্ধকারের চেহারা আরও ভয়ংকর হতো এটিই গূঢ়ার্থ, এটিই মনস্তত্ত্ব।

তৃতীয় কবিতা ; এই কবিতায় একজন প্রকৃত বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক যেন জবানবন্দি দিচ্ছে। শিক্ষকেরা সমাজে মানুষ বানানোর কারিগর। অথচ পুঁজিবাদী সমাজ রাষ্ট্রে সে সম্মানিত শিক্ষক শ্রেণি বেশি রকম নিষ্পেষিত। অধিকন্তু পর্যদুস্ত। উল্লিখিত কবিতাত্রয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই, অনর্থপাত নেই। নিপুণ ছন্দের মিস্তিরি বখতিয়ার এবং তাঁর কবিতা ভাষ্য হয়ে ওঠে সমাজ ভাবনার অতল চেহারা। নানাবিধ অসংগতি অসংলগ্ন মানবিক জীবনের কণ্ঠরোধ কবিতার বিষয়বস্তু। কবিতা চিন্তায় তিনি স্বদেশজাত ও বৈশ্বিক। অসম্ভব প্রাণস্পর্শী শব্দ ও বাক্যের শরাঘাতে ইঙ্গিতে তিনি কবিতাকে পৌঁছে দেন মানুষের কাতারে । ইংগিত ধর্ম, চিত্রকল্পের দৃশ্যগত সংস্করণএবং সুচারু ইন্দ্রিয়গম্যতা; সমস্ত জারান অনুষঙ্গ বুননে বখতিয়ার ক্রমশই সামনের দিকে হাঁটার অভ্যাস করছেন।

কবিতা নিয়ে শেষ কথা থাকেনা। কবি যে সমাজে বাস করেন সাধারণত সে সমাজ চিত্র তাঁর লেখায় ওঠে আসে। আবার কবি যদি হয় বিশ্ববীক্ষায় আদৃত, কবির সময় চিন্তায় বিশ্ব সংকট, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থান উত্থানপতনের বার্তা আসবে, স্বাভাবিক। অগ্রসর সমাজ চিত্র কখনোসখনো বিমূর্ত ও লুন্যাটিক হয়। ইউরোপীয় সমাজ মানস চিন্তা এবং অগ্রসর দর্শন ও অভিজ্ঞান সময়ের চেয়ে বেশি অগ্রসর হওয়ার কারণে এক ধরনের আচ্ছনতা, উলম্ব সিস্মোগ্রাফি সৃষ্টি হয়েছে কাব্যতিহাসের কর্ষিত জায়গায়।

কবি শ.. বখতিয়ার, তাঁর দীর্ঘদিনের স্থানিক সামাজিক কানেক্টিভিটি ও বৈশ্বিক অভিজ্ঞানের কারণে কবিতা নিয়ে ভাবতে পেরেছেন বিস্তর। তাঁর কবিতার বিষয় ক্রনলজি বেশ সুন্দর ও মর্মগ্রাহী। কবিতা আখ্যান অসংখ্য প্রিজম্যাটিক দ্যুতি নিয়ে আবর্তিত। কবি শ. . বখতিয়ার, সকল হ্যাজিমনির বিপরীতে সমাজমনস্ক জীবনবাদী এক কবিকণ্ঠ।

লেখক : কবি, শিল্পসমালোচক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবোধনের ‘জাগো সুন্দর’