শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেন ভুলে না যাই

মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। ১৯৪৬ সাল ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো। পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর জন্ম। সৃষ্টি থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র হরণ করে নেয়। এই অধিকার বঞ্চিত সময়ে আমার বড় ভাই সাইফুদ্দিন খালেদ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকেন। উপলব্ধি শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন।

প্রথমে পাকিস্তানিরা আঘাত হানে বাঙালির মাতৃভাষার উপর। আঘাত হানে ‘মা’কে। ‘মা’ বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ফুসে উঠে পূর্ব বাংলার মানুষ। এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে মাতৃভাষা ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করে। সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক এদের রক্ত থেকে সৃষ্টি হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের। সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী পূর্ব বাংলার এই করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর মনে সৃষ্টি হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালির শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তখন গড়ে ওঠে পূর্ব বাংলা ছাত্র সমাজে আন্দোলন। তখন সাইফুদ্দিন খালেদ সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওয়াজিউল্লাহ এবং বাবুলের রক্তের বিনিময়ে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত। পঞ্চাশ দশকের স্বাধীকার আন্দোলন এবং ষাটের দশকের শেষ নাগাদ স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সে আন্দোলনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন। এই পর্যায়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল পূর্ব বাংলা ছাত্র সমাজ। সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী ছাত্রাবস্থায় ষাটের দশকে স্বাধীকার ও সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন। গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন আহ্‌বানে ও অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সহযোদ্ধাদের নিয়ে। সহযোদ্ধারা হলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব, বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোজাফফর আহমদ, কানুনগোপাড়া কলেজের তরুণ অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা ও সাংসদ সুলতানুল কবীর চৌধুরী, তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অন্যতম ছাত্রনেতা ফিরোজ আহমদ, রামু নিবাসী তৎকালীন স্টিল মিলের শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম চৌধুরী। এদেরকে নিয়ে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী গাড়িচালক ইসলামের গাড়িতে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অপারেশনে যাওয়ার পথে রাউজান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পাক সেনাদের মুখোমুখি হয়। পাক হানাদার বাহিনী তাদের গাড়িতে আক্রমণ চালায়। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, আবদুর রব, শেখ মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও গাড়ি চালক ইসলাম। থেমে যায় এই তরুণ সম্ভাবনাময় দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সুলতানুল কবীর চৌধুরী, ফিরোজ আহমদ।

শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর পিতা জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় জোনের বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখলে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার ছেলে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী কোথায়?’ কেউ কেউ বলতো: বেঁচে আছে। আবার কেউ কেউ বলতো: মারা গেছে। তখন এসব বিভিন্ন ধরনের কথা শুনে তিনি বলতেন: ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমার ছেলেকে উৎসর্গ করলাম। হে আল্লাহ, আমার প্রার্থনা কবুল কর।’

সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী ছোটবেলায় বলতেন, ‘জন্মেই দেখি ক্ষুদ্র স্বদেশ ভূমি।’ তিনি কোনোদিন পূর্ব পাকিস্তান বলেননি। পূর্ব বাংলাই বলতেন সবসময়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী স্বাধীন সার্বভৌম জন্মভূমি বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি।

লেখক: শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর অনুজ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদের রক্ত পরাভব মানে না : বিনম্র শ্রদ্ধা শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম