বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে শ্রম সংস্কারে ডেনমার্কের সহায়তা কামনা করেছেন। তিনি শ্রম সংস্কারকে সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। শ্রম সংস্কার কেবল শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্যই নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশকে শক্তিশালী ও টেকসই করার জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
শ্রম সংস্কারের গুরুত্ব:
শ্রম সংস্কার একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। শ্রমের ন্যায্য মূল্যায়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার পাশাপাশি, উৎপাদনকারীদের জন্য একটি সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি হয়। উন্নত কর্মপরিবেশে কাজ করলে শ্রমিকেরা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
আইএলও কনভেনশনের গুরুত্ব:
অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশনগুলো বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এই কনভেনশনগুলো শ্রমিকদের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে, যা বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এই কনভেনশনগুলোর বাস্তবায়ন শ্রমশক্তির উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বৃদ্ধি করবে।
বিদেশি বিনিয়োগের প্রভাব:
বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদেশি কোম্পানিগুলি সাধারণত উন্নত প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল নিয়ে আসে, যা স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। তবে, বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি নিরাপদ ও সুষ্ঠু শ্রম বাজার গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। শ্রম সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার এবং সুবিধা নিশ্চিত হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবে।
শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন:
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ৬টি কমিশন গঠন করেছে। তবে শ্রম সংস্কারের জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। এই কমিশনটি শ্রম বাজারের সমস্যা চিহ্নিত করবে, শ্রম আইন ও নিয়মাবলী পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন আইন প্রণয়ন করবে। এই উদ্যোগটি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও শ্রম সংস্কার:
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বিভিন্ন খাতে দ্রুত উন্নতি করছে। তবে, শ্রম বাজারের কাঠামোগত সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে, যেমন শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং বেসরকারি খাতের নির্যাতন। শ্রম সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে এইসব সমস্যার সমাধান হলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও শক্তিশালী হবে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এই সংস্কারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজের সকল স্তরের অংশগ্রহণ:
শ্রম সংস্কারের প্রক্রিয়ায় সরকারের পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠন, শিল্প মালিক এবং নাগরিক সমাজের সকল স্তরের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের মতামত নেয়া এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হলে, তাদের মধ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণের গুরুত্ব:
শ্রম সংস্কারের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। শ্রমিকদের মধ্যে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হলে, তারা নিজেদের অধিকার রক্ষায় আরো সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারবে। এর মাধ্যমে শ্রম পরিবেশ উন্নয়ন হবে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার: বাংলাদেশে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি। দেশে ২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরের জন্য ন্যাশনাল একশন প্ল্যান আছে এবং জাতীয় শ্রম নীতিমালা রয়েছে। সর্বোপরি, ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সহাস্রাধিক মানুষের আত্মাহুতির বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে স্বপ্ন সঞ্চারিত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ছাড়া সম্ভব নয়।
শ্রম সংস্কার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অপরিহার্য অংশ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্য এদেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নাগরিক সমাজের মনে প্রত্যাশা তৈরি করেছে। এই প্রত্যাশা পূরণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে শ্রম বাজারের সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। শ্রম সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে, দেশের শ্রম বাজারের কাঠামো পরিবর্তন হবে এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। আমাদের উচিত শ্রম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে এবং এর বাস্তবায়নে সকল স্তরের সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
লেখক: বিলস–ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক।