সামগ্রিকভাবে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি দেশের সার্বিক অর্থনীতির গতিকে বাড়িয়ে দেয়। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নে বেশ গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। এ কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। প্রায় তিন বছর আগে এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন (এপিও) ডাটাবুক ২০১৮-এর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন। এর পরের অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। তৃতীয় অবস্থানে আছে ভারত। শ্রীলংকা চতুর্থ অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে যৌথভাবে পঞ্চম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০-২০১৬ সাল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে প্রথম অবস্থানে আছে চীন। ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। ৪ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হয়ে তৃতীয় অবস্থানে ভারত। ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি করে চতুর্থ অবস্থানে শ্রীলংকা। ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে যৌথভাবে পঞ্চম অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে ষষ্ঠ থাইল্যান্ড। সপ্তম অবস্থানে পাকিস্তান। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ১ শতাংশ। আর ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে অষ্টম স্থানে আছে নেপাল।
লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশ নিচে, বিশ্বের অন্যতম নিম্নতম। তাই শ্রম সস্তা নিয়ে আমাদের বড়াই করলে চলে না- বলেছেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। যেখানে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম থাকে, সেখানে বাইরের লোক আসে না। আমাদের সমপর্যায়ের অর্থনীতি ভিয়েতনামে; কিন্তু এই উৎপাদনশীলতা অনেক উঁচুতে। সেখানে যাচ্ছেও অনেকে। ড. সালেহ উদ্দিন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দুর্বল। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো ও ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মতো উন্নয়ন সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ব্যবসাবান্ধব হতে পারেনি। এখনো ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা রকম বাধা বিদ্যমান। নানা রকম সমস্যায় ভুগতে হয় উদ্যোক্তাদের। যেমন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়। যে কোনো পলিসি বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মূল দায়িত্বে থাকে নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাজার ব্যবস্থাপনা, যেখানে প্রতিযোগিতা আছে কিনা, স্বচ্ছতা আছে কিনা সেটা তাদের দেখতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা নেই, বেশিরভাগই গোষ্ঠীভিত্তিক চলে, ঋণ ম্যানিপুলেট করে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিষয়টি যেকোনো দেশের উন্নতির জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মক্ষম নাগরিকদের শ্রম দেওয়ার ক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি উন্নতি করেছে, সেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তত বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে এবং বিশ্বায়নের ধাক্কা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। এর কারণ- শ্রমের উৎপাদনশীলতার সক্ষমতার সাথে উন্নতি ও পণ্যের মূল্য সরাসরি সংশ্লিষ্ট। তাই বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে উন্নয়নকামী বেশির ভাগ দেশ তার নাগরিকদের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম কেন! এ বিষয়ে কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি খাতে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাজে জবাবদিহিতা কম, সুশাসনে রয়েছে ঘাটতি, যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব- এমন আরো অনেক কারণ বিদ্যমান। এ অবস্থায় বিদ্যমান শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি দুরাশা। কিন্তু বিশ্ব তো বসে নেই- ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিমান মানুষ নিয়ে চালিত দেশগুলো তার নাগরিকদের শ্রমের উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি অটোমেশন, রোবট, ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- প্রভৃতিতে সম্ভাব্য সবই বিনিয়োগ করছে। ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, পণ্যের মূল্যও বাড়ছে। বাংলাদেশ ইদানীং প্রযুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পারছে, কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতায় এখনো অনেক পিছিয়ে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, দেশের মানুষ তত বেশি বেকার হবে।
আমরা জানি, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।এজন্য প্রতিটি নাগরিককে সুস্থ-সবল রাখতে হবে- শারীরিক ও মানসিক সবভাবেই। সরকারও খুব তৎপর এ ব্যাপারে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে হলে বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে।