শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বিজয়া দশমী

রূপম চক্রবর্ত্তী | মঙ্গলবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

ষষ্ঠীতে দেবী দুর্গা স্বামীগৃহ ছেড়ে সপরিবারে এসেছিলেন পিতৃগৃহে। দশমী তিথিতে দেবী আবার পাড়ি দেবেন কৈলাসে। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় এবং শুরু হয় আবার এক বছরের অপেক্ষার পালা। ‘দশমী’ মানেই ঘরের মেয়ে অর্থাৎ উমার এবার বিদায় বেলা। স্বভাবতই মন খারাপ থাকে সকলের। কারো মন চায় না মেয়েকে বিদায় দিতে। কিন্তু, নিয়মানুযায়ী বিদায় তো দিতেই হবে। তাই হাজারো মন খারাপের মাঝেও হাসিমুখে সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিমুখের মাধ্যমে মহা আড়ম্বরে ঘরের মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে ব্যস্ত থাকেন সকলে। মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। প্রাচীন যুগে এই দিনে ক্ষত্রিয়রা অস্ত্র পুজো করে পরের দিন যুদ্ধে রওনা দিতেন।

এই বিজয়া দশমীর প্রকৃত তাৎপর্য হয়তো অনেকেরই অজানা। পিতৃগৃহ ছেড়ে উমা এবার ফিরে যাবেন কৈলাশে স্বামী মহাদেবের কাছে। তাই মর্ত্যবাসীর মন খারাপ। দুর্গাপুজোর এই শেষ দিনটিকে দশমী বা বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। কেন দশমীকে বিজয়া দশমী বলা হয়, তা এখন জেনে নেব আমরা। মহিষাসুর নামে এক অসুর ব্রহ্মার বর পেয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করেন। ব্রহ্মা তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে কোনও পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না। তবে কোনও নারী তাঁকে বধ করতে পারবেন না, এমন বর দেওয়া হয়নি। তখন সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনী অনুসারে টানা নয় দিন ও নয় রাত্রি যুদ্ধের পর শুক্লা দশমীতে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। এই বিজয় লাভকেই বিজয়া দশমী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

মহাভারতের বিরাট পর্বে দেখা যায়, পাণ্ডবেরা চৌদ্দ বছর বনবাসের পরে এক বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার রাজ্যে পরিচয় বদলে ছদ্মনামে বসবাস করছিলেন। এই সময় কীচক দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করায় ভীম তাঁকে হত্যা করেন এবং এই সংবাদ দুর্যোধন কোনওভাবে জানতে পেরে অনুমান করেন বিরাট রাজ্যেই পাণ্ডবেরা লুকিয়ে আছে। তাই কৌরবেরা সসৈন্যে বিরাট রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। বিরাট রাজার পুত্র উত্তর বৃহন্নলারূপী অর্জুনকে নিয়ে শমী গাছের নীচে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তখনই উত্তর সব ঘটনা জানতে পারেন। কুরুবাহিনীর সঙ্গে অর্জুন একা লড়েন। অর্জুন মহাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের প্রত্যেককে পরাজিত করেন। মহাসম্মোহন অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি সমস্ত কুরু সৈন্যকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কিছু কিছু পৌরাণিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, অর্জুনের এই বিজয়ের দিনটি এবং রামচন্দ্রের বিজয়ের দিনটি একই। রামচন্দ্রের মতোই অর্জুনেরও জয়ের সূচক বিজয়া দশমী। জয় থেকেই বিজয়া এসেছে।

রানী রাসমনির জামাতা মথুরবাবু একদা আবির্ভূত হয়ে বিজয়ের দিনে দেবীকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসে ছিলেন তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাকে বোঝান যে বিজয়ের অর্থই মা এবং সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। মা কখনোই সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। রামকৃষ্ণদেব আরো বলেন যে, এতদিন বাইরে দালানে বসে মা পূজা নিয়েছিলেন, আজ থেকে মা মনের মন্দিরে বসে পূজা নেবেন। এই ব্যাখ্যায় মথুরবাবুর মনের আঁধার দূর হয়।

প্রাধানিক রহস্য’ গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হয়েছে ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈবৃ।’ অর্থাৎ যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। দেবী সাকার রূপে মর্ত্যে পূজা গ্রহণ করেছেন, তারপর নিরাকার রূপে ফিরে গিয়েছেন কৈলাসে। তার অর্থ সন্তানের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ নয়। মাসন্তানের চিরমিলনের এই শাস্ত্রীয় তত্ত্বই প্রাঞ্জলভাবে মথুরবাবুকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ।

দশমীর সকালে এক কৌটা সিঁদুর নিয়ে মায়ের মন্দিরে যাওয়া এবং সেই সিঁদুর থেকে কিছুটা মায়ের চরণে অর্পণ করা বাকিটা বাড়ি নিয়ে চলে আসা। সেই সিঁদুর সারাবছর পুরুষমহিলা নির্বিশেষে ব্যবহার করেন বিপদ দূর করার শক্তি হিসেবে। বিজয়া দশমীর দিন সকালে রাম মন্দিরে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো।

দশমী পূজার অঞ্জলি দেওয়ার সময় সাদা বা নীল অপরাজিতা ফুল অর্পণ করা। শক্তির আরাধনা চলতে থাকে। অতঃপর দশম দিনে মাকে বিশেষ ভাবে সম্মান জানানো হয়। তার পর মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। আসছে বছর আবার এসো, এই বলে তাঁকে আবাহন জানানো হয়। শুরু হয় সকল বিভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে মিষ্টিমুখ করা। দশমীর এই আনন্দ চলতে থাকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত। সকলেই এই উপলক্ষ্যে এক সাথে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়।

বিজয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জ্ঞান অর্জন দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে। এ শুভদিনে ধনীদরিদ্র, রাজাপ্রজা, পণ্ডিতমূর্খ, উঁচুনিচু বিচার না করেই সকলে একাত্মবোধে আবদ্ধ। সকল ক্ষুদ্রতা ও পাশবিক বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানের ভাবনা জাগ্রত করে মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ার সাধনাই হচ্ছে মায়ের বিজয়া দশমীর বিসর্জন পর্ব।

মাতৃজাতি তথা নারী জাতিকে সম্মান করা অবশ্য কর্তব্য। যখনই সংসারে কোনও সমস্যা আসে, নারী তার সকল শক্তি দিয়ে রক্ষা করে। মানবিকতা, ন্যায় বিচার, ভালোবাসা, সেবা দিয়ে সকল সমস্যার সমাধান করে। মা দুর্গার পুজোতে নারী জাতিও উদ্বুদ্ধ হয়। মা যেমন পরিবারকে সঙ্গে আনেন এবং শত্রু বিনাশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন, তারাও তেমনই তাদের পরিবারকে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ রেখে সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। ছোটোরা গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, সমবয়সীরা আলিঙ্গন করেন আর গুরুজনেরাও ছোটোদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশারদীয় ঐতিহ্য ও সমপ্রীতির বন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধবহুমাত্রিক মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী