ড. আসমা সিরাজুদ্দীন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জাতীয় অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের সহধর্মিনী। ২০১৭ সালে বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার কিছুদিন পর তৎকালীন সভাপতি বর্তমান কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক স্যারের উদ্যোগে শ্রদ্ধেয় আলমগীর স্যার ও তাঁর সহধর্মিনী আসমা ম্যাডামের সাথে পরিচয়ের সূচনা। বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্যারের বক্তৃতা শুনলেও ম্যাডামকে এই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখা। ম্যাডামকে দেখে মনে হল তিনি আপাদমস্তক একজন অভিজাত, নান্দনিক, মার্জিত, সজ্জন এবং মিষ্টি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সাধারণের চেয়ে বেশ দীর্ঘকায় এবং কিছুটা বিদেশী টানে বলা বাংলা উচ্চারণ ছিল ভীষণ মায়াবী। উনার কথাগুলো বাংলা ও উর্দুর মিশেলে যেন বহুদিনের অনাবিস্কৃত ভাষা যা অনন্য সাজের সংস্কৃতি। হাসিটুকুন ম্যাডামের মুখাবয়বে লেগেই ছিলো। অল্প সময়ের ব্যবধানে খুব আপন করে নিলেন। যেন বহুবছরের একটা সম্পর্ক; যা কখনো ভোলার নয়।
আসমা হক ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. আবদুল হক যিনি লাহোর ডেন্টাল কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন এবং মাতা সাদত বতুল। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে আসমা হক ছিলেন পঞ্চম। শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবারেই। তিনি ১৯৫৭ সালে লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. এবং ১৯৫৯ সালে চারুকলায় এম. এ. পাশ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৬০ সালে লাহোর মহিলা কলেজের চারুকলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্বদ্যিালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (SOAS) পড়তে যান এবং ১৯৬৫ সালে হর্নসি কলেজ অব আর্ট থেকে “Pictorial Art During the Umayyad Period, Dissertation in partial fulfillment of the requirements” বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনের হর্নসি কলেজ অব আর্ট এর চারুকলায় স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নের সময় পূর্ব পাকিস্তানের কমনওয়েলথ স্কলার আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের সাথে আসমা হকের পরিচয়। সিরাজুদ্দীন যিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS) এ দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের উপর পিএইচডি এবং পরবর্তীতে বার-এট-ল সম্পন্ন করেন।
১৯৬৬ সালে দু’জনের এই পরিচয় পরিণয়ে রূপ নেয় এবং আসমা হক হয়ে যান আসমা সিরাজুদ্দীন। তিনি ১৯৬৫ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “Architectural Representations in Persian Miniature Painting During the Timurid and safavid Periods” অভিসন্দর্ভের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে লন্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ ফেলো হিসেবে “Catalog of Professor Storey’s Oriental Books of Collection” বিষয়ে কাজ করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭৪-৭৫ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টোরাল করেন। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮০-৮৩ সাল পর্যন্ত ইতিহাস বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ড. আসমা ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের “Leadership Exchange Program” বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৮৬-৮৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে “Aga Khan Program for Islamic Architecture” এর সহযোগী গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া ১৯৯৬ এবং ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দীনের গবেষণা ও পাঠদানের প্রধান বিষয় ছিল ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস, ইন্দো-মুসলিম কলা ও স্থাপত্য এবং মুসলিম আমলে বাংলার স্থাপত্য, মুদ্রা ও লিপি। ইংরেজি, উর্দু ছাড়া আরবী ও ফার্সি ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা তাঁর গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে। শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাশ লেকচার বোধগম্য করতে বাংলা ভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করেন। তিনি শিক্ষা ও গবেষণার কাজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যাণ্ড, অস্ট্রিয়া, ইতালী, জার্মানী, নেদারল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, ভারত, পাকিস্তান এবং নেপাল ভ্রমণ করেন।
ড. আসমা বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল আর্কাইভস এডভাইজরি কাউন্সিল, আর্কিওলজিক্যাল এডভাইজরি কাউন্সিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম ট্রাস্টের ট্রাস্টি, একাডেমিক কাউন্সিল, এডভান্সড স্টাডিজ কমিটি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সদস্যপদ অলংকৃত করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষক-কর্মচারীদের এপ্রিল ও মে মাসের বেতন বাকি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য পাক সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার কাইয়ুম চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ইউ এন সিদ্দিকীকে সার্কিট হাউজ অফিসে ডেকে নিয়ে অনুরোধ করেন। তাই সিদ্দিকী সাহেব চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষক কর্মচারীদের খোঁজ খবর করতে থাকেন। কিন্তু ভয়ে কোনো শিক্ষক পাক সেনাপতির সাথে দেখা করার সাহস করেননি। পরবর্তীতে ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন স্যার ও আসমা ম্যাডামের চেষ্টাতেই ব্রিগেডিয়ার কাইয়ুম কোষাধ্যক্ষ ইউ এন সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আসমা ম্যাডাম ছিলেন পাঞ্জাবি মহিলা এবং ঐ সময় সার্কিট হাউজে কর্তব্যরত একজন মেজর তাঁর আত্মীয় ছিলেন। সেই আত্মীয়ের মাধ্যমেই তাঁরা সামরিক কর্তৃপক্ষকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার আবেদন জানান। এছাড়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমানকে সার্কিট হাউজে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সেখানে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হতো। তার দুইদিকে দু’জন রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এভাবে তাকে প্রায় এক সপ্তাহ হাজিরা দিতে হয়। এক্ষেত্রেও আসমা ম্যাডাম নিজ প্রচেষ্টায় খলিলুর রহমানকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে মহানুভবতার পরিচয় দেন।
অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন উপাচার্য থাকাকালীন ছাত্ররা একবার পাহাড়ের ওপর উপাচার্যের বাসভবন অবরোধ করে রাখে। অবরোধকারী বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা অভুক্ত আছে এই ভেবে অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দীন খাবার ও পানি পাঠিয়ে মমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
শ্রদ্ধেয় আলমগীর স্যারের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, ধর্মপ্রাণ আসমা ম্যাডাম সবসময় সততা, নৈতিকতা, উদারতা ও মানবিক মূল্যবোধকে অন্তরে ধারণ করে চলতেন। যার কারণে স্যারও যাতে উপাচার্য থাকাকালীন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত না হয়; কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকার অনুপ্রেরণা ও সাহস জোগাতেন এবং ছোটবেলা থেকেই একমাত্র সন্তান উমর সিরাজুদ্দীনকেও এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যাতে তাঁর মধ্যে কোনো অহমিকাবোধ গড়ে না উঠে। (উমর সিরাজুদ্দীন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ম্যানেজার, ‘গ্লোবাল পলিসি মেকিং ও এসডিজি মনিটরিং’ হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত আছেন।) এমনই ছিলেন আমাদের আসমা ম্যাডাম।
করোনার আগে অসুস্থ ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে স্যার বললেন, তুমি একদিন বাসায় এসে তোমার ম্যাডামকে দেখে যাও; ও খুব খুশি হবে। এরই প্রেক্ষিতে স্যারের বাসায় যাওয়া; সময়টা ছিল ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার পড়ন্ত বিকেলে। বিছানায় শয্যাশায়ী ম্যাডামকে মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি অস্পষ্ট ভাষায় বললেন, “আমি খুব ভালো আছি; অসুস্থতা উপরওয়ালার ইচ্ছা। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মনে হল আমার যদি একটি মেয়ে থাকতো; আমি তোমার জন্য দোয়া করি।” এরপর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অসুস্থতা সত্ত্বেও ম্যাডাম সেটা নিয়ে কখনো দুঃখবোধ করেননি।
শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দীন একটি ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর এই খ্যাতি ব্যক্তিগত, পেশাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, ব্যক্তিত্ব, ভাষাগত পাণ্ডিত্য এবং প্রাণবন্ত শ্রেণিকক্ষের বক্তৃতা ও আলোচনার উপর প্রতিষ্ঠিত। পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে এদেশে এসে শিক্ষকতা করে কাটানো প্রায় ৩৫ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই ছিল আসমা ম্যাডামের জীবন। এই প্রাঙ্গনে থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাইতো এদেশের মায়া তিনি ছাড়তে পারেননি। ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে দু’বছরের অধিককাল শয্যাশায়ী আসমা ম্যাডাম দীর্ঘ ৬০ বছরের জীবনসঙ্গীকে একা রেখে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার নিজ বাসভূমে মৃত্যুবরণ করেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ম্যাডামকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত করুন। অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁর প্রাণের জায়গা প্রিয় ক্যাম্পাস তথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। কবির ভাষায় –
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়,
নয় সম্পর্ক ছিন্ন করা
চলে গেলে আরো অধিক কিছু
থেকে যায়, এই না থাকা জুড়ে….”
ব্যক্তিগত জীবনে সহজ, সরল, নিরহংকারী, অমায়িক ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মমতাময়ী জ্ঞানতাপস আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর এই না থাকাটাই সম্পর্কের পরিসমাপ্তি নয়। আরো অধিক হয়ে রয়ে গেলেন আমার কিংবা আমাদের মাঝে এই না থাকার পরও। প্রিয় ম্যাডাম আপনার কর্ম, কীর্তিগুণে অগণিত শিক্ষার্থীদের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগযুগান্তর।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।