বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সিরাজুল আলম খান এক মহাকাব্যিক চরিত্র। অনেকে তাকে সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনা করেন আবার অনেকে এ্যরিস্টটলের সাথে, আবার অনেকে মনে করেন তিনি হলেন হ্যামিলনের বংশিবাদক, আবার অনেকে তাকে মনে করেন কাপালিক হিসেবে। আসলে তাকে নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে তার রাজনীতির হাতেখড়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তিনি আর কোনো সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না।
যখন তার বয়স একুশ তখন থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন কীভাবে বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন করার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি তার দুই সতীর্থ নিয়ে গঠন করেন ‘নিউক্লিয়াস’। এরা হলেন আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ। সময়টা ১৯৬২ সালের শেষের দিকে। তারা আঙুল কেটে রক্ত শপথে নিজেদেরকে আবদ্ধ করলেন বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে না। ‘নিউক্লিয়াস’ সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামেও পরিচিত ছিল। সিরাজুল আলম খান ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজেকে ষোলো আনা নিয়োজিত করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছাত্রলীগের ভিতরে ‘নিউক্লিয়াস’ মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। ‘৬৪ সাল থেকে ‘নিউক্লিয়াস’কে সাংগঠনিক রূপ দিতে থাকেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে, যা সারা পূর্ব বঙ্গে সাত হাজার সদস্যের এক বিশাল সাংগঠনিক রূপ ধারণ করেন। তিনি ছাত্রলীগের ভিতর হ্যামিলনের বংশিবাদকের ভূমিকা পালন করেন। সিরাজুল আলম খানকে এই সময়ে বুদ্ধি পরামর্শ দিতেন ড.আহমদ শরীফ এবং কামরুদ্দিন আহমেদ। অর্থাৎ তারা ‘নিউক্লিয়াস’ এর পরামর্শক ছিলেন।
‘নিউক্লিয়াস’ই ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলনসহ ১১ দফা আন্দোলনের পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে এই সবক’টি আন্দোলন পরিচালনা করে ‘নিউক্লিয়াস’। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে ১১দফা আন্দোলন পরিচালনা করা হয়। ‘নিউক্লিয়াস’এর রাজনৈতিক উইং ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ)। ’৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মূলে ছিল ‘নিউক্লিয়াস’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা, ‘জয়বাংলা’কে জাতীয় শ্লোগান হিসেবে নির্বাচন করা, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’কে জাতীয় সংগীত হিসাবে নির্ধারণ করা, জাতীয় পতাকা তৈরী ও ২ মার্চ আ.স.ম. রবকে দিয়ে উত্তোলন করা এবং ৩ মার্চ শাহজাহান সিরাজকে দিয়ে ইশতেহার পাঠ করানো সবগুলোর নেপথ্যে নায়ক হলেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কথা উল্লেখ ছিল, যা সিরাজুল আলম খানের কারণে। আজকের দিনে কি কল্পনা করা যায় তিন তরুণের দ্বারা গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ ‘বাঙালির জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সঠিক পরিণতির দিকে কীভাবে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সার্থক আন্দোলন ও ঘটনাবলিকে সেই সময় অনেকেই বিশ্বাসও করতে পারেনি ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন হবে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করলে আরো পরিষ্কার হবে। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ চট্টগ্রামের ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যরা মনে করলো বেতার কেন্দ্র চালু করার। তারা চট্টগ্রাম বেতারের কলাকুশলিদের নিকটে গিয়ে ধর্ণা দিল তারা যেন বেতার কেন্দ্র চালু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা প্রচার করে। কিন্তু বেতারের লোকজন ‘নিউক্লিয়াস’ এর ছাত্রলীগের সদস্যদের পাত্তাই দেয়নি। তখন ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে বেতার কেন্দ্র চালু করতে বাধ্য করে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম কণ্ঠ হলো রাখাল চন্দ্র বনিকের। সেই সময় তিনি ছিলেন ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম উত্তর মহকুমার সভাপতি। আর ভাষণ দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এম.এ. হান্নান। ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করেন।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে অনেককে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে তিনি নেতা বানিয়েছেন এবং তাঁর অনেক শিষ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী ও সরকার এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এখনো আছেন।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে অনেকে নেতিবাচক প্রচারণা এবং বক্তব্য দিয়ে তাদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছেন এবং করে যাচ্ছেন। যদিও বা তা তথ্যসমৃদ্ধ নয় এবং যুক্তিহীন।
ষাটের দশকের ৬২ সালের শিক্ষা, ’৬৬ সালের ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১১দফা আন্দোলনের মূল রূপকার ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি ৬ এবং ১১দফা আন্দোলনে শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল ভূমিকা তো পালন করেছেন ‘নিউক্লিয়াস’ এবং তার চালিকা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র সমর্পণের দিন সিরাজুল আলম খানের মুখে মূল শ্লোগান ছিল বিশ্বে এলো নতুন বাদ মুজিব বাদ মুজিব বাদ। এর অর্থ হলো সিরাজুল আলম খান চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু থাকবেন সকল সমালোচনার উর্ধ্বে -এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে মহাত্মা গান্ধী, মাও সেতুং মতো অবস্থানে রাখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অনেকে তা চাননি। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
জুনের ১০ তারিখে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডক্টর তোফায়েল আহমেদ তার ওয়ালে লেখেন, ‘তার ধারণা হয়েছে সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার ধারা সক্রেটিসের মতো। তাকে নানা জনে ইতিবাচক নেতিবাচক নানা রকম অভিধায় ভূষিত করেছেন। কেউ বলেন কাপালিক, কারও গুরু, কেউ বলেন রহস্য পুরুষ, বেশির ভাগই ‘তাত্ত্বিক’ দাদা। তোফায়েল আহমেদ মনে করেন সিরাজুল আলম খান বিরামহীনভাবে ডায়ালগ করতেন, বলতেন এবং শুনতেন। অনেক সময় কোনো উপসংহার থাকতো না। লোকে তার কাছ থেকে শেষ কথা শুনতে চাইতেন। উনি তা করতেন না। ‘তোমার উপসংহার তুমিই টান।’
সিরাজুল আলম খান ছিলেন খুবই ভালো গবেষক। তিনি ইউএসএ এর উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর জিল্লুর রহমান খানের সাথে মিলিত ভাবে লিখেছেন -Constitutional and Constitutional issues নামে এক গবেষণামূলক গ্রন্থ। ‘বাংলাদেশের তৃতীয় জাগরণ’ তার আর একটি উন্নত মানের গ্রন্থ। আমেরিকা সহ বিশ্বের অনেক নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। বাংলাদেশের এই মহান বীরের তিরোধানে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। লেখক : সাংবাদিক