শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন

হৈমন্তী তালুকদার | সোমবার , ১৮ জুলাই, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের পর থেকেই এই দেয়া নেওয়া, কাপড় চোপড় দেয়া, দাম বিবেচনায় ওগুলোর দোষ ধরা, বরকে কী কী দিলো, এসি ক্লাবের ডিমান্ড, খই, নাড়ু, বছরের ফল, রোজায় ইফতার, কোরবানে গরু, মহিষ, ছাগলের ডিমান্ড করে। শ্বশুরবাড়িতে সামর্থ্য থাকলেও না থাকলেও সামাজিকতার নামে বউকে কটু কথা শুনানো, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।

আমাদের চট্টগ্রামের কিছু জায়গায় কিছু মানুষের এমন আশাতীত সামাজিকতার চাপে দাম্পত্যকলহ বেড়েই চলেছে। মেয়ে পক্ষের জিনিসের প্রতি এতো লোভ এদের অথচ বউকে কী দিলো, ছেলের শ্বশুরবাড়িতে জামাই কী সমাদর করলো? এ নিয়ে কোনো কথা নেই, সবসময়ই আমাদের নারীদের চলন, বলন নিয়ে কটু কথা, এটা ওটা খোঁটা দিয়ে মেন্টাল টর্চার করা হয়, যার কারণে কোনো কোনো বউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়, কোনো কোনো সংসারে দাম্পত্যকলহ বাড়তেই থাকে তা বিচ্ছেদের দিকে এগোয়। এসব অদৃশ্য যৌতুকের কারণে। এই পৃথিবীটা যেন বিষাক্ত মনে হয় তখন ঐ মেয়েটার কাছে। সামাজিকতার নামে দফায় দফায় এসব সামলাতে গিয়ে কোনো কোনো বাবা নিঃস্বও হয়ে যায়। তবুও মেয়ের সংসারের শান্তিরক্ষায় বাবা সব করে যায় চোখের জল ফেলে। কিন্তু এর শেষ কোথায়?

আমরা কোন সংস্কৃতি ধারণ করছি? নারী আর পুরুষের সমতা কিভাবে হয় আমাদের সমাজে? সেইরকম হলে বিয়েতে শুধু মেয়ের বাবাই কেন একা বিয়ের দাওয়াতের সব খরচ করে? এনগেইজমেন্ট, বিয়ে, জামাইভাতা, বেয়াইভাতা, বরকে সোনার জিনিস, টিভি, ফ্রিজ মোটর সাইকেল একাধারে চাপগুলো সারাজীবন কেন মেয়ের বাবার? ছেলের বাবার দিকে কেন সবসময়ই চাপ কম? কোন দিকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হলো? সংসারে একটু খুঁটখাট হলে কেন মেয়ের বাবাকে বারবার মাথা নিঁচু করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয়? ঘরের বউরা সাংসারিক সামান্য ভুল করলে বাবাকে হাজার কথা শুনতে হয়, আর জামাইরা অপরাধ করলেও কিছু বলা যায় না। আমাদের সমাজে নারীদের কোথায় তাহলে মূল্যায়ন হলো? সামাজিকতার নামে আমাদের সমাজে যে নিয়মগুলো এখনো বহমান আসলে এগুলো অনিয়ম। সব কথার এক কথা কিছু বড়লোকদের পরিবারে মেয়েদের পরিবারকে সম্মান করতে দেখা গেলেও তারা কিন্তু সমাজকে পরিবর্তন করে না।

আমি তখনই সৃজনশীল মানুষ হবো যখন সমাজের অনিয়মগুলোকে প্রতিহত করবো, অন্যায় হলে অনিয়ম হলে তারাও নীরব ভূমিকায় থাকে। সমাজে এখনো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সব জায়গায় এই নীরব যৌতুক বহমান। নীরবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সইতে না পেরে কতো সালেহা কতো মিতুরা প্রাণ দেয় অকালে। এভাবে যৌতুকের নামে যে সামাজিকতার অসুস্থতা আমাদের অজান্তে মনে ভর করে আছে এগুলো সারানো দরকার।

শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে খেয়ে মানুষ হয়ে আসে, তারা তো খেতে আসেনা, সমাজের নিয়মে তারা থাকতে বাধ্য হয়। তবুও খাওয়া পরার খোঁটা শুনতে হয়। কিছু হলেই শ্বশুরবাড়িতে তাদের জায়গা হয় না। বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেন সমঝোতা হয়না, একটি পরিবারে কেন আমরা অশান্তি সৃষ্টি করি? কেন তাদের আলাদা করি? কেন তাদের মিলিয়ে দিতে চাই না? আমরা কোন সমাজ? যারা অন্যায়কে প্রশয় দিই, আমরা কোন বিবেক? কিসের শিক্ষিত সমপ্রদায়? আমরা এখনো পরের মেয়েদের অসম্মানিত করা হলে নিজেদের ছেলেদের একটা চড় মেরে শাসিয়ে বলতে পারি না এই কাপুরুষ আমার বউমাকে অসম্মান করবি না। তাহলে তোর কোনো জায়গা নেই আমার ঘরে। আমরা কেন পরের মেয়েকে বলতে পারি না তুমি কেন যাবে বউমা? এটা তোমার ঘর।

আমরা তা করি না, আমরা নীরব দর্শক, আমরা সাধু সভ্য সমাজ। আমরা নিজেদের নিয়ে ভাবি। আমরা ভালো আছি। যে পরিবারে ঘরের বউরা নির্যাতিত হয় তাদের সাথে যদি পুরো সমাজ প্রতিবাদ করে হয়তো মিতু, সালেহাদের মতো অকালে প্রাণ যেতো না, সন্তান মা হারা হতো না। কতো নারী মেনে নেয় আর মানিয়ে নেয় এভাবে তার হিসেব নেই। চট্টগ্রামে এই বিষয়টা অত্যন্ত ঘৃণা লাগে, যৌতুকের নীরব চাহিদা সামাজিকতার নামে মেয়েদের নির্যাতন বন্ধ হোক। মেয়ের বাবার নিচু করে রাখা মাথাটা কবে উঁচু করবে সমাজ। আর কতো?

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাকী জীবন
পরবর্তী নিবন্ধবিদ্যুৎ সঙ্কট : জ্বালানিখাতে সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি