শোকে-অশ্রুতে শেষ বিদায়

আজাদী প্রতিবেদন ও হাটহাজারী প্রতিনিধি | রবিবার , ৩১ জুলাই, ২০২২ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

মধ্য শ্রাবণেও খরতাপে যখন চৌচির চারিধার, ঠিক তখন শোকে বিহ্বল হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের চোখে শ্রাবণ ধারা। নির্দিষ্ট কোনো বাড়ি নয়, সব বাড়িতেই শোকের মাতম। নতুন কেউ ওই গ্রামে ঢুকলে সহজেই বুঝতে পারবেন, কিছু একটা হয়েছে এখানে। কারো মুখে হাসি নেই, রাস্তায় স্থানে স্থানে জটলা। প্রায় সকলের পরনে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। এক দিন আগেও যেখানের পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক; সে এলাকায় স্বজন, বন্ধু কিংবা প্রতিবেশী হারানোর বেদনায় ভারি হয়ে উঠছে পরিবেশ। হাসি নেই চলতি পথের মানুষগুলোর কারো মুখে। চেহারায় বেদনার ছাপ, স্বজন হারানোর বেদনা। গত শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরে মীরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে চলন্ত মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের আরোহী যে ১১ জন নিহত হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই খন্দকিয়া ও আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা।
খন্দকিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৯টার আগে থেকেই খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হতে থাকে স্থানীয় লোকজন। স্কুলের মাঠে তৈরি করা হয়েছে একটি প্যান্ডেল, যেখানে সারি সারি করে রাখা হয়েছে নিহত ছয় জনের লাশ। খাটিয়াগুলোতে চিরনিদ্রায় শায়িত ওয়াহিদুল আলম জিসান, জিয়াউল হক সজীব, ইকবাল হোসেন মারুফ, গোলাম মোস্তফা নীরু ও সামিরুল ইসলাম হাসান। পৌনে ১০টার দিকে স্কুল মাঠে যখন লাশগুলো নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন স্বজনদের কান্নায় স্কুল মাঠের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছিল, জানাযায় আসা লোকজনের অনেকের চোখের কোণায় জমছে অশ্রুবিন্দু। আর নিহতদের বাড়িতে স্বজন হারানোদের সান্ত্বনা দিতে ছুটে গেছেন প্রতিবেশী নারী ও স্বজনরা। খন্দকিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের অল্প ব্যবধানে কোচিং সেন্টারের পরিচালক জিয়াউল হক জিসানের বাড়ি। তার একশ গজের মধ্যেই ইকবাল হোসেন মারুফের নানা বাড়ি, যেখানে থেকে পড়াশোনা করছিলেন তিনি। জিসানের ঘরের সামনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাকে, বিপরীতে কয়েক গজের ব্যবধানে মারুফের কবর।
ঘর ছেড়ে সকল পুরুষ, তরুণ, যুবক, কিশোর এসেছেন সেই মাঠে। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ। কেউ কাঁদছেন, কেউ স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। অঘোষিতভাবে বন্ধ স্কুল। মাঠ পেরিয়ে মানুষ জমে যায় সড়কেও। নিহতদের স্বজনরা কেউ আহাজারি করতে করতে, কেউ নীরবে চোখের পানি নিয়ে হাজির হন জানাজার মাঠে। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয় নামাজে জানাজা।
প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় নিহত জিয়াউল হক সজিব, রিদুয়ানুল চৌধুরী, সামিরুল ইসলাম হাসান, ইকবাল হোসেন মারুফ ও মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরুর জানাযা। কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে মোসাব আহমেদ হিশামের জানাযা। স্থানীয়দের পাশাপাশি জানাজায় অংশ নেন স্থানীয় সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। বাকি তিনজনের খাটিয়া নিয়ে মানুষ এগিয়ে চলে তাদের বাড়ির দিকে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়েছে। নিহত শান্ত শীলকে তার বাড়িতে পারিবারিক শ্মশানে শনিবার সকাল ৭টায় সৎকার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী থানার ওসি রুহুল আমীন।
নিহতদের মধ্যে সাতজনের বাড়ি চিকনদন্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামে। নিহত রাকিবের বাড়ি একই উপজেলার শিকারপুর, সাজ্জাদের মাদার্শা, শান্ত শীলের সরকারহাট এবং আশিকের বাড়ি ফতেহপুর গ্রামে। আহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি খন্দকিয়া গ্রামে। শুধুমাত্র মাইক্রোবাস চালকের সহকারী শাওনের বাসা নগরীর শেরশাহ এলাকায়।
জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে তিনজন স্কুল ছাত্র ও ছয়জন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সামিরুল, হিশাম ও মারুফ খন্দকিয়া গ্রামের কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। সজীব ওমরগণি এমইএস কলেজের গণিত প্রথম বর্ষের ছাত্র। জিসান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। রিদওয়ানুল চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। রাকিব হাটহাজারী কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে অনার্সে ভর্তির জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। আশিক ও শান্ত শীল কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। নিহত সজীব, রিদওয়ানুল, রাকিব ও জিসান যুগীরহাটের আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের পরিচালক ছিলেন। সামিরুল, হিশাম, মারুফ, আশিক ও শান্ত ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী। নিহত সাজ্জাদ পড়ালেখার সঙ্গে যুক্ত নন। সজীবের বন্ধু হিসেবে তিনিও পিকনিকে গিয়েছিলেন। নিহত গোলাম মোস্তফা নীরুও সজীবের বন্ধু এবং মাইক্রোবাসটির চালক ছিলেন। আহতদের মধ্যে তছমির, আয়াতুল ও সৈকত কেএস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। মাহিম ও হৃদয় কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একইসঙ্গে যাওয়া কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. ইমন (১৯) অক্ষত আছেন। তাকে চমেক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।
আর অ্যান্ড জে প্রাইভেট কেয়ার কোচিং সেন্টারটিতে পড়াতেন আব্দুল্লাহ আরিফ রিসাদ। তিনি আজাদীকে জানান, গত মার্চ মাসে কোচিং সেন্টারটি চালু করা হয়েছিল। সজীব, জিসান, রিদুয়ান ও রাকিব মিলে কোচিং সেন্টারটি চালু করেন। আমিসহ ৬ শিক্ষক সেখানে পড়াতাম। কোচিং সেন্টারের চার পরিচালকই চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহিদুল আলম জানান, দুর্ঘটনায় নিহতদের দাফন কাফনের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের জন্য নগদ ১৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যথাসম্ভব দ্রুত এ সহায়তার অর্থ তাদের পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআড়াই বছরে ১১৬ দুর্ঘটনা, ২১৯ প্রাণহানি
পরবর্তী নিবন্ধবৃষ্টির অভাব, রোপা আমন নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা