নগরের সিআরবি সাত রাস্তার মোড় থেকে শিরীষতলা যেতে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল তা নেই। বাধা নেই গাড়ি প্রবেশেও। এ সড়কে প্রতিদিনের ভিড় নেই। শিরীষতলায় প্রবেশের সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে সিএনজি টেক্সি থামান চালক। টেঙি থেকে নেমেও অবাক হতে হয়, লোকজন কম, কেমন ফাঁকা। বইমেলা মঞ্চ থেকেও আসছে না কোনো মাইক বা সাউন্ড বক্সের শব্দ। মঞ্চের সামনে বাতিগুলোও জ্বলছে না। রোজকার চিত্রের পাল্টে যাওয়া এ দৃশ্য গতকাল সন্ধ্যার। এখান থেকে সহজেই বলা যায়, কিছু সময় পরেই আলো নিভবে বইমেলার।
হ্যাঁ, গত রাতে সত্যি সত্যি আলো নিভেছে বইমেলার। এর মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হলো ২৩ দিনব্যাপী অমর একুশে বইমেলার। সিআরবি শিরীষতলায় আয়োজিত এ বইমেলায় এবার সাড়ে ৪ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, যা গতবারের চেয়ে দেড় কোটি টাকা বেশি। গতবার (২০২৩) ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। এবার বইমেলায় ৪০৫টি নতুন বই এনেছেন প্রকাশকরা। এর মধ্যে গল্প, উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছিল কম। বেশিরভাগই ছিল প্রবন্ধের। যার উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত। এ তথ্য বইমেলার আয়োজক কমিটির দায়িত্বশীলদের।
অবশ্য প্রকাশকদের অনেকে দাবি করেছেন, তাদের বিক্রি গতবারের চেয়ে কম হয়েছে। তবে এসব দাবির বেশিরভাগই করেছেন চট্টগ্রামের প্রকাশকরা। বিপরীতে ঢাকার দামি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচিত এবং খ্যাতিমান লেখকের বই বেরিয়েছে তাদের বিক্রি ছিল বেশি। এর মধ্যে প্রথমা, বাতিঘর ও কথাপ্রকাশ উল্লেখযোগ্য।
বইমেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করেন। এবারের মেলায় ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ৯২ প্রকাশনা সংস্থার ১৫৫টি স্টল ছিল।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে আয়োজিত এ বইমেলা এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এবার খেলার মাঠ হওয়ায় এ মাঠে বইমেলা আয়োজনে আপত্তি জানায় জেলা প্রশাসন। তাই বিকল্প হিসেবে সিআরবি শিরীষতলাকে বেছে নেয়া হয়। তবে নিরাপত্তাসহ নানা কারণে পরিবর্তিত স্থানে মেলা জমবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। সব সংশংয় কাটিয়ে শেষ হয় মেলা। আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী, গতবারের চেয়ে বিক্রিও বেড়েছে।
বইমেলার আহ্বায়ক ও চসিকের কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমদ মঞ্জু আজাদীকে বলেন, নতুন জায়গা হিসেবে মেলা শতভাগ সফল হয়েছে। প্রকাশকরা শুরুতে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু একটি বইও চুরি হয়নি। এটা আমাদের সাফল্য। ধুলোবালিও হয়নি তেমন। বিক্রিও ভালো হয়েছে। তাই প্রকাশকরাও খুশি। সব মিলিয়ে বলা যায় সুন্দর আয়োজন এবং আমরা সফল।
কোনো ত্রুটি ছিল কিনা জানতে চাইলে বলেন, স্টল বাড়াতে হবে। মেলার স্থানও বাড়াতে হবে। লেখক আড্ডার জায়গা আরো বড় করতে হবে। আগামীবার এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেব।
বইমেলার দপ্তর উপ–কমিটির সদস্য সচিব আইউব সৈয়দ আজাদীকে বলেন, মেলায় ৪০৫টি নতুন বই এসেছে। বেশিরভাগ প্রবন্ধ এবং রাজনৈতিক গ্রন্থ। পুরো ২৩ দিনে সাড়ে ৪ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ ৫৮ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছে বসন্ত উৎসবের দিন। সবচেয়ে কম ২ লাখ ১৮ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছে শবে বরাতের দিন।
চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলী প্রয়াস আজাদীকে বলেন, মেলামঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দও বেশি ছিল। অথচ জোর দেওয়া উচিত ছিল মূল মেলায়। প্রচারণা আরেকটু বেশি হওয়া উচিত ছিল বইমেলার।
এবার মেলায় প্রকৃত প্রকাশকের বাইরেও আন্দরকিল্লার অনেক বইয়ের দোকানেরও স্টল ছিল। এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে যারা অংশ নেয় তারা আমাদের সংগঠনের সদস্য। আমাদের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত ছিল, চট্টগ্রামের এক প্রকাশনার বই অন্য প্রকাশনার স্টলে এবং জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের কোনো লেখকের বই দেশের যে কোনো জায়গা থেকে বের হলে তা চট্টগ্রামের স্টলগুলোতে রাখা যাবে। সেজন্য এক প্রকাশনার বই অন্য প্রকাশনার স্টলে দেখা গেছে। তবে কোনো পাইরেসি বই মেলায় ছিল না।
প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু আজাদীকে বলেন, বেচাকেনা খারাপ হয়নি। তবে জিমনেশিয়াম মাঠে বেশি হয়েছে।
চন্দ্রবিন্দুর স্বত্বাধিকারী মঈন ফারুক বলেন, জিমনেশিয়াম মাঠের চেয়ে এখানে বেচাকেনা কম হয়েছে। প্রচুর মানুষ এলেও এদের বেশিরভাগ ঘুরতে এসেছেন। প্রকৃত ক্রেতা কম ছিল।
এমেলিয়া প্রকাশনের আফছার উদ্দিন লিটন বলেন, জিমনেশিয়াম মাঠ ভালো ছিল। জিমনেশিয়ামে শেষ পাঁচদিন গড়ে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হয়, এখানে দুই হাজার টাকার কম হচ্ছে।
তবে ঢাকা থেকে আসা কথাপ্রকাশের বিক্রয়কর্মী রাজু আজাদীকে বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পেয়েছি।
আদর্শ প্রকাশনার বিক্রয়কর্মী মিজান বলেন, খারাপ হয়নি। ভালোই সাড়া পেয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বই বেশি বিক্রি হয়েছে।
প্রায় প্রতিদিন মেলায় আনসা আতিক নামে এক পাঠক আজাদীকে বলেন, গুছানো আয়োজন মনে হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অনেক বয়স্ক লোক আসেনি। জিমনেশিয়াম থেকে শিরীষতলার পরিবেশ ভালো। তবে প্রচারণা কম হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
লেখক সোহেল মাহরুফ আজাদীকে বলেন, সিআরবি বইমেলার জন্য চমৎকার জায়গা। এখানকার পরিবেশও চমৎকার। যেসব স্টলে ভালো বই ছিল তাদের ওখানে পাঠকের ভিড় ছিল এবং তাদের বিক্রিও ভালো হয়েছে।