‘নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি’, ‘মুখোশের দিন বৃষ্টির রাত’ ও ‘কালো শালোয়ার ও অন্যান্য গল্প’ এই তিনটি বই প্যাকেট করেন তো। নগরের সিআরবি শিরীষতলায় চলমান বইমেলায় গতকাল সন্ধ্যায় বাতিঘর প্রকাশনের বিক্রয়কর্মীকে এ কথা বলে টেবিলে সাজিয়ে রাখা বই দেখছিলেন আনুমানিক পঞ্চাশোর্ধ্ব শিহাব উদ্দিন। তার এক হাতেও ছিল বইভর্তি ব্যাগ।
জানতে চাইলে তিনি দৈনিক আজাদীকে জানান, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবরক্ষক পদে কর্মরত আছেন। মেলায় এর আগে দুইবার এসেছেন। তখন বইয়ের তালিকা সংগ্রহ করেন এবং কয়েকটি বই পছন্দ করে যান। যেহেতু মেলা শেষ হওয়ার পথে তাই পছন্দ করা বই কিনছেন। বাতিঘর ছাড়াও প্রথমা, কথাপ্রকাশ ও চন্দ্রবিন্দু থেকেও পছন্দ করে রাখা কয়েকটি বই কিনবেন বলে জানান তিনি। এসময় বেচাকেনা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে বাতিঘরের বিক্রয়কর্মী বাবলু বলেন, মোটামুটি হচ্ছে, খারাপ না।
গতকাল মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা গেছে, স্টলের সামনে ভিড়। গত আগের কয়েকদিনের তুলনায় গতকাল বিক্রি বেশি হওয়ার কথা জানান কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলের বিক্রয়কর্মীরা। তাদের সবার কথায় প্রায় একইসুর, মেলা শেষের পথে তাই পাঠক আর অপেক্ষা করছেন না। এবার তারা কেনায় মনোযোগ দিয়েছেন।
আদিগন্ত প্রকাশন এর আরিফ রায়হান বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় বেচাকেনা বেড়েছে। কাল–পরশু (আজ ও আগামীকাল) বন্ধের দিন হওয়ায় বেচাকেনা আরো বাড়বে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এর এক বিক্রয়কর্মী বলেন, মেলা শেষের পথে। তাই বেচাকেনা একটু বেড়েছে। মোজাফ্ফর হোসেনের ‘নো ওম্যান’স ল্যান্ড’ ও কিঙ্কর আহসানের ‘ইনসান’ বেশি চলছে বলে জানান তিনি।
নতুন বইয়ের খবর : আপন আলো থেকে বেরিয়েছে আজাদ বুলবুলের গবেষণা প্রন্থ ‘চাকমা সংস্কৃতির রূপ রূপান্তর’, চন্দ্রবিন্দু থেকে বেরিয়েছে কাজী জাহঙ্গীরের কাব্যগ্রন্থ ‘বেয়োনেট ইউক্যালিপটাসের’ এবং শৈলী প্রকাশন থেকে বেরিয়ে ইসমাইল জসীমের কিশোর কাব্যগ্রন্থ ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’, লিপি বড়ুয়ার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমার দিগন্তজুড়ে তোমার সীমানা’।
‘চাকমা সংস্কৃতির রূপ রূপান্তর’ আজাদ বুলবুলের ‘নিছক একাডেমিক তত্ত্বের সন্দর্ভ নয়, বরং চাকমা জাতির বর্ণিল সংস্কৃতির অনালোচিত অধ্যায়’। এর ফ্ল্যাপে লেখা আছে– চাকমাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্য জনপদে বসবাসরত প্রাণোচ্ছল আদিবাসী জনজাতি। বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাগণ সবচেয়ে সংখ্যাধিক্য ও প্রাগ্রসর। তাদের রয়েছে প্রামাণ্য ইতিহাস, সমৃদ্ধ ভাষা ও বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। চাকমাদের ধর্মীয় আচরণ, উৎসব–পার্বণ, নৃত্যগীত, লোকসাহিত্য ইত্যাদি আদিবাসী সংস্কৃতির অনালোচিত অধ্যায়। তাদের ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হলেও এতে চাকমা সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রতিভাত হয়নি। ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশের চাকমা জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে গবেষণা শুরু হলেও সবটাই পরিচিতিমূলক বিবরণে পরিপূর্ণ। স্বতন্ত্র গবেষণায় কৃতিত্ব প্রদর্শনের চাইতে দায়সারা ভাবটাই ছিলো প্রবল।
‘চাকমা সংস্কৃতির রূপ রূপান্তর’ সম্পর্কে আজাদ বুলবুল বলেন, দীর্ঘদিন চাকমা জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে থেকেছি। তাদের জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করেছি। অংশ নিয়েছি তাদের উৎসব অনুষ্ঠানে। ‘চাকমা সংস্কৃতির রূপ রূপান্তর’ খুঁজতে গিয়ে অংশগ্রহণমূলক গবেষণা পদ্ধতিতে তুলে এনেছি এই জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, উৎপাদন, বিনোদন, রন্ধন থেকে যাপিত জীবনের সকল বিষয় আশয়।
‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’ কাব্যগ্রন্থে ১৯টি কিশোর কবিতা আছে। শিশুসাহিত্যিক শিবুকান্তি দাশের মতে, ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’ বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ মনকাড়া। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু দেশ সমাজ সচেতনতামূলক বিষয়ে লেখা কবিতাগুলো সত্যিই মন টানে।
বেয়োনেট ইউক্যালিপ্টাসের ফ্ল্যাপে লেখা আছে– কবিতা স্মৃতির, বর্তমানেরও। যোগ হয় দ্রোহ–প্রেম। ইতিহাস যেমন থাকে, তেমনি থাকে ঐতিহ্য। তার সাথে নতুন সূচনার কথামালা বোনা হয়। জীবনের অনন্য ভাবনাগুলো কবিতা হয়ে ফোটে। নানা অনুষঙ্গ নিয়ে অগ্রসর হয়। স্বপ্নের কথা, হতাশার কথাও মিলেমিশে নামে। ইংগিতে বেয়োনেটকে ইউক্যালিপ্টাসের আকার দিয়ে অন্য অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে দেখিয়ে দেয়াই যেন কবির অভিপ্রেত।
ছড়া উৎসব : বইমেলা মঞ্চে গতকাল ছড়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিশু সাহিত্যিক কবি রাশেদ রউফ। সম্মানীত আলোচক ছিলেন ভারতের আগরতলা থেকে আগত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. দেবব্রত দেবরায়। চসিক প্যানেল মেয়র মো. গিয়াস উদ্দিনের সভাপতিত্বে আলোচক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি, কবি শুকলাল দাশ, কলামিস্ট ড. মাসুম চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন কবি উৎপল কান্তি বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে ৫৭ জন ছড়াকার ছড়া পাঠ করেন।
রাশেদ রউফ বলেন, শুধু লোক ভোলানো–শিশুদের জন্য নয়। ছড়া সমাজ–রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছড়া বিকশিত হয়েছে। ক্রমশ সৃষ্টি হয়েছে ছড়ার শাখা–প্রশাখা, পত্র–পল্লব। বাংলাদেশের ছড়ায় শিশুতোষ সংখ্যার আধিক্য বেশি। অধিকাংশই শিশুমনস্তত্ত্ব নির্ভর। এসব শিশুতোষ ছড়ায় রাজনীতির ছোঁয়া নেই, সমসাময়িক টানাপড়েন নেই, আছে শুধু ছোটদের আনন্দদানের প্রচেষ্টা। তবে যে ছড়া শিশুদের ঘুম পাড়ানিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সে ছড়া ক্রমশ পরিণত হয়েছে ঘুম জাগানিয়ায়। ছড়ার ভাষাও হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার, প্রতিবাদের মাধ্যম। দেশের নানা ক্রান্তিকালে ছড়াশিল্পীরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে।
ড. দেবব্রত দেবরায় বলেন, ভারত–বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও প্রাচীন। দুই দেশের সাধারণ মানুষকে মৈত্রীর বন্ধনে নিয়ে আসার জন্য উভয় দেশের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে।
সিরু বাঙালি বলেন, ছড়ার মাধ্যমে ছড়াকাররা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন গনতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
শুকলাল দাশ বলেন, ছড়াকাররা সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। তারা প্রতিনিয়ত সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকেন। সৃষ্টিশীল লেখা সবসময় আনন্দের ও প্রেরণার। মানুষের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য লেখার কোনো বিকল্প নেই।
ড. মাসুম চৌধুরী বলেন, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যে জাতির কাছে জ্ঞান ভাণ্ডার আছে সেই জাতি বিশ্বের নেতৃত্ব দিবে। তিনি বই মেলাকে জ্ঞান আহরণের কেন্দ্র বলে অভিহিত করেন।
অনুষ্ঠানে ছড়া পাঠ করেন– বিপুল বড়ুয়া, অরুণ শীল, সনজীব বড়ুয়া, শিবুকান্তি দাশ, মিজানুর রহমান শামীম, কেশব জিপসী, গোফরান উদ্দিন টিটু, ফারজানা রহমান শিমু, সাইফুল্লাহ কায়সার, সেলিনা আক্তার আনম, সুসেন কান্তি দাশ, বিদ্যুৎ কুমার দাস, সৈয়দা সেলিমা আক্তার, অপু বড়ুয়া, ওবায়দুল সমীর, নবারুন বড়ুয়া, আবু তালেব বেলালসহ ৫৭ জন ছড়াকার।