করোনায় আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লোকজনের কাছ থেকে যখন আত্মীয়-পরিজন পালানোর পথ খুঁজছিল তখনই অনাত্মীয় লোকজনকে দাফন-কাফনে মাঠে নেমেছিল কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। চট্টগ্রাম নগরীর পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তারা বহু লাশ দাফন করেছে। আত্মীয়ের চেয়ে বড় আত্মীয় হয়ে তারা শেষ বিদায় জানিয়েছে অসংখ্য মানুষকে। এক্ষেত্রে জাতি ধর্মের কোন ভেদাভেদ তারা দেখাননি। সব ধর্মের সব মানুষকে স্ব স্ব ধর্মানুযায়ী দাফন এবং সৎকার করেছে তারা। জানা যায়, চট্টগ্রামে প্রায় আড়াইশ’ মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
করোনার ভয়াল থাবায় চট্টগ্রামে মারা যাওয়া অসংখ্য মানুষের দাফন-কাফন নিয়ে যখন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চরমে উঠছিল তখন আরো কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী মানবিক সংগঠনের পাশাপাশি মাঠে নামে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। নগরীর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানেও মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে সংগঠনটি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে খবর দেয়া হলেই তাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা হাজির হতেন হাসপাতালে। ওখান থেকে মরদেহ নিয়ে নিজেরাই গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে আত্মীয়দের দিতেন। আবার যাদের আত্মীয়রা নিজেরা লাশ না নিয়ে দাফন করিয়ে দিতে বলতেন তাদের দাফনের ব্যবস্থাও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন করে দিত। ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সৎকারের কাজও করে দিয়েছে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই যাত্রায় চট্টগ্রামে সর্বমোট ২৫১ জন মানুষকে শেষ বিদায় জানিয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এদের মধ্যে ১৬০ জন মুসলিম, ৭১ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী, ১৬ জন বৌদ্ধ এবং ৪ জন খৃষ্টান। এদের মধ্যে পুরুষ ছিল ১৬৯ জন এবং মহিলা ৮২ জন।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা কোন ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই পুরো করোনাকালেই লাশ দাফন-কাফনের মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। করোনার ভয়াবহতা পৃথিবী থেকে বিদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াবে এই ফাউন্ডেশন।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে রয়েছেন মহিলা স্বেচ্ছাসেবকও। যারা মহিলাদের লাশ যথাযথ সম্মানের সাথে গোসল দেয়া থেকে প্রয়োজনীয় সব কাজ করে দেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন গতকালও একটি মরদেহ নোয়াখালী পাঠিয়েছেন বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের নিজস্ব এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। আমরা এ্যাম্বুলেন্স সাপোর্ট দিতে পারি। তবে দূরে কোথাও লাশ পরিবহনের জন্য ফ্রিজিং ভ্যান আমাদের নেই। ওই সাপোর্ট আমরা দিতে পারিনা। এক্ষেত্রে লাশের আত্মীয় স্বজনেরা ফ্রিজিং ভ্যান ভাড়া করেন। আমরা লাশ গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে কফিনে কিংবা বডি ব্যাগে ভর্তি করে দিই। যাতে দাফনের সময় আর কোন সমস্যা না হয়। করোনাকালে আত্মীয়রা যখন পালানোর পথ খুঁজছিল তখন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বিপন্ন মানুষের আত্মীয় হয়ে উঠেছিল।
আলাপকালে একাধিক স্বেচ্ছাসেবক দৈনিক আজাদীকে বলেন, করোনাকাল আমাদের অনেক কিছুই দেখিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দেখিয়েছে মানুষের অচিন হয়ে উঠা। নিজের সন্তান কিভাবে পর হয়ে গিয়েছিল তা খুব কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল আমাদের। পরিচয় উল্লেখ না করে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, বেশ ধনাঢ্য একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার সন্তানসহ আত্মীয়দের কেউই কাছে আসেননি। দ্রুত দাফন-কাফন করার ব্যবস্থা করতে তাগাদা দিচ্ছিলেন। আমরা গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে নগরীর একটি কবরস্থানে লাশটি দাফন করেছিলাম। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র মানুষ ছিল ওই ব্যক্তির শেষ বিদায়ের বিষন্ন সময়ে।
অপর একটি ঘটনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর বেশ কান্না করছিলেন তার সন্তানেরা। কিন্তু গোসল দেয়ার পরও মায়ের লাশটি শেষবারের মতো দেখতে কাছে আসেননি ওই সন্তানেরা। বিষয়টি কাছ থেকে দেখেছেন বলেও জানালেন এক স্বেচ্ছাসেবক। করোনাকালে এই ধরনের অনেক বিবর্ণ গল্প তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্বেচ্ছাসেবক দৈনিক আজাদীকে বলেন, পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। করোনাকে এখন আর আগের মতো ভয় পাচ্ছেন না মানুষ। এখন দাফন কাফনের সময় দূর থেকেও হলেও বিদায় জানান আত্মীয়স্বজন। করোনায় মারা গেলেও ঘন্টা কয়েকের মধ্যে লাশে আর কোন জীবাণু থাকে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মানবিক প্রচেষ্টা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।