শেষের যাত্রী

করুণা আচার্য | শনিবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর সবাই যখন প্রথম হওয়ার লড়াইয়ে মগ্ন তখন মিতু মনে মনে ভাবতে লাগল সবাই আগে যাক, আগে পাক, আগে খাক, আমি বাপু সবার পরেই যাব। ক্ষতি কী তাতে? সেই তো আমি যাবোই। এই সব ভাবতে ভাবতে তার নাকের ডগা দিয়ে দোহাজারী থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন আবার জানালি স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সব যাত্রীর উঠানামা শেষ। হেইহেইহেই ট্র্‌েনতো ছেড়ে দিলো। ‘তাড়াতাড়ি উঠে এসো, তাড়াতাড়ি উঠে এসো’ বলে কে যেন বারবার বলতে লাগল। কানে স্পষ্ট ভেসে আসল কথাটা। কন্ঠটাতো চেনা চেনা মনে হলো না। তবে কে সে? যেভাবে ডাকছিল মনে হলো যেন আমি গাড়িতে না উঠলেই তারই বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আরে বাবা, বললাম তো আমি ধাক্কাধাক্কি সহ্য করতে পারি না। যার তাড়া আছে সে আগে চলে যাক । প্রতিদিন ট্রেনে এমন পরিস্থিতি অনেকের পোহাতে হয়। তাতে কার কি? আমাকে বাড়িতে কেউ কিছু বলে না। আর বলবেই বা কেন? অনেকেই জানে আমি যে শেষের যাত্রী।

এদিকে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর কিছু লোক তার দিকে তেড়ে এসে বলতে লাগল, এই মেয়ে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? ট্রেনতো চলে গেলো! তুমি তো গাড়ি ফেল করলা, সেজন্যে তো দেখছি তোমার কোনো আফসোস নেই। দেখি দিব্যি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছ। প্রথম জন বলল্‌গাড়ি তো চলে গেলো? তুমি কেন এখনও প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছো বাপু ?

এত কিছু বলার পরও লোকের কৌতূহল যেন কমলোই না। এই দেশে কী মেয়েরা একা কোথাও দাঁড়াতেও পারবে না ? আর গাড়ি ফেলতো করতেই পারে মানুষ। তাই না? তাই বলে মানুষকে কেন এত জবাবদিহিতা করতে হবে? কই পুরুষরা সারারাত রাস্তায় থাকলেও তো কারো কোনো মাথাব্যথা দেখি না বাপু!

এই তো সেইদিন দেখলাম বটতলী স্টেশন থেকে এক ভদ্রমহিলা সীতাকুন্ডে যাবে বলে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল। মাঝপথে মনে হলো তাঁর পানের কৌটাটা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ফেলে এসেছে। তাঁর কাছে এই মুহূর্তে মনে হল গাড়ি থেকে নেমে,আগে পানের কৌটো খুঁজে আনতে হবে।

সে মহিলা আগপিছ কিছু না ভেবে চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইছিল। মহিলাটার সাহস আছে বলতে হবে। পারছে না সে পানের কৌটোর জন্য চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পড়ে। একএকজন মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবে। তবে মৃত্যুঝুঁকি আছে বলে হয়ত ঐদিন গাড়িশুদ্ধ মানুষ চেঁচিয়ে ঐ নারীর নিশ্চিত মৃত্যু আটকে দিয়েছিল। তা মানুষের বলাটা ঠিকই ছিল। কিন্তু আজ আমি কি সত্যি সত্যি গাড়ি ফেল করেছি নাকি ইচ্ছে করে গাড়িতে উঠিনি তা জানার আগ্রহ কারো দেখলাম না। সবাই মিলে হৈহুল্লা শুরু করে দিয়েছে মেয়েমানুষ এত রাতেও গাড়িতে উঠলো না বা ইচ্ছে করে গাড়িটা হারালো।

মিতুর কানে ভেসে এলো আবারও ঐ ডাকটা। এতো লোকের ভিড়ে সে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো কে সে বারবার “হেই মেয়ে উঠে এসো, হেই মেয়ে উঠে এসো” বলে তাড়া দিয়েছিল? কে সে? কেউ আবার আমার পিছু নিলো নাকি ? না না আমার আবার পিছু নেবে কে? এতদিন রাত করে করে বাড়ি আসা যাওয়া করছি এমন তো কখনো হয়নি।

মাকে কথা দিয়ে এসেছি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো। হাতে এত কম টাকা নিয়ে কোন দিন বের হইনি। ধারেকাছে জানাশুনা কারো বাড়িও তো নেই যে আজ রাতটা কাটিয়ে নাহয় কাল ট্রেন ধরব। ইস্‌ কেন যে সবার মতো ধাক্কাধাক্কি ভিড়ভাট্টা ঠেলে ট্রেনে উঠে গেলাম না কে জানে। এদিকে আবার মাকে কথা দিয়ে এলাম তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব। মাঝে মাঝে নিজের কি যে হয় বুঝি না। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে আমার।

এতোদিন হয়ে গেল শহরের কলেজে ভর্তি হলাম, এখনো শহুরে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছি না। বিপদকে আমি ভয় পাই না ঠিকই তবে সেটা আমার এলাকায় হলে এতক্ষণে দেখিয়ে দিতাম ক্ষণ! রাস্তায় নারী দেখলেই বুঝি মানুষের গা চুলকায়? আমি আছি আমার জ্বালায় আর ওরা আছে আমাকে বিব্রত করার তালে। রাস্তাটাকি ওদের বাবার কিনা জানতে ইচ্ছে করছে।

আজ ভাগ্যটা আমার দুই দিকেই খারাপ। একদিকে হাতে বেশি টাকা নিয়ে আসিনি, অন্যদিকে ফেল করা গাড়িটা যে ছিল শেষ গাড়ি তা বুঝে উঠতে পারিনি। এবার ভয়টা আস্তে আস্তে গভীর হতে লাগল। এক পা এক পা করে ঘিরে ধরা লোকের কাছ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা লোক অটো নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল আর ধমক দিয়ে বলল, ‘এসো এসো তো আর অভিমান দেখাতে হবেনা অযথা তোমার জন্য আমাকে ট্রেন থেকে নেমে এই অটো ভাড়া নিতে হলো।’ মিতু হতচকিত হয়ে বলল, ওমা তুমি কে আবার? লোকটির এবার হুশ ফিরে এল, তাই তো! এত লোকের সামনে সত্যিই তো সে নিজের কি বলে পরিচয় দেবে। ‘কেন তুমি কি আমায় চিনতে পারছ না? আমি বিমল। ও অবশ্য অনেক দিন দেখা না হওয়াতে ভুলে গেছো এইতো ? তুমি আমি এক ইস্কুলে পড়তাম মনে নেই তোমার?’ এইভাবে অভিনয় না করলে মিতুকে এত লোকের মাঝখান থেকে বের করে আনা সম্ভব হতো না। যাক চিনাচেনি পরে হবে আগে গাড়িতে উঠে এসো তো।’ বিমল মনে মনে ভাবল এত লোকের ভিড় ঠেলে তাকে উদ্ধার করাই হলো এখন আমার মোক্ষম কাজ।

মিতুও মনে মনে ভাবল আসলে তো ঠিক কথা ও আমাকে না চিনলে গাড়িতে এত লোক থাকতে কেউ বলল না গাড়িতে উঠে এসো। আর আমি উঠিনি বলে গাড়ি থেকে কেউ নেমে এলো না ও কেন নেমে এল ? নিশ্চয় আমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আগপিছ ভাবতে ভাবতে মিতু লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। যাক ভাগ্যে যা আছে আজ তাই হবে কি আর করা। অন্তত এতো লোকের অত্যাচার থেকে তো বাঁচা যাবে।

মিতুর উদ্দেশ্যে প্রথমে বিমল কথা বলল, অনেক বছর আগের কথা মনে আছে কিনা জানি না, আমার বন্ধু স্বপনকে দিয়ে আমি একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলাম তোমার কাছে। চিরকুটটি রিফিউস করে তার সামনেই ছিড়ে ফেলেছিলে তুমি। সেই কথাটা শুনে তখনই আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম তোমার পিছু আমি ছাড়বো না। তোমাকে আমার চাই চাই তাই সেই থেকে আমি তক্কে তক্কে ছিলাম কোন্‌ দিন এই সুযোগটা আমার কাছে ধরা দেবে। ভাগ্যিস আজ আমি তোমার সে ফেল করা গাড়িতে উঠেছিলাম। যাক আজ ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন বলতে হবে। ও হ্যাঁ, সেই থেকেই আমি তোমার প্রতিটা পদে পদে আমি আমার পা চালিয়েছি। বলতে পারো তোমার পায়ের ছাপ যেখানেযেখানে পড়েছে সেখানেসেখানে আমারও পায়ের ছাপ পড়েছে। মিতুর মন তখন ভয়ে টনটন করতে লাগল। মনে মনে বলল, প্রতিশোধের পাল্লায় ফেঁসে গেলাম তো!

বিমল এবার চুপ করে রইল। চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপরও মিতুর কোন সাড়া পেল না দেখে সে আবার ও বকবক শুরু করল। বিমল পুরানো কাসুন্ধি বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে। চুপচাপ শুনতে শুনতে এক সময় দেখল গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে তার বাড়ির গেইটে।

যাক বাবা! লোকটাকে যা ভেবেছিলাম তার থেকে ঢের ভাল আছে দেখছি। সরাসরি বাড়ি এনে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে।

মানুষকে আসলে এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়।

গাড়ি থেকে নামার আগে মিতু ছোট্ট করে ধন্যবাদ বলে নেমে পড়ল। গাড়িকে বিদায় দিয়ে বিমলও সেখানে নেমে গেল। মিতুর পিছু পিছু ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় মিতু বাধা দিয়ে জানতে চাইল ঘরে প্রবেশের অনুমতি না নিয়ে ঘরে ঢুকার সাহস কে দিল। যে এতক্ষণ বাধ্য ছাত্রীর মতো আমার পাশে গাড়িতে বসে আসতে পারল তার বিলম্বের জবাব দিতে আমি ঘরে প্রবেশ করছি তাতে অনুমতি নেওয়া না নেওয়ার কি আছে। মিতু বলল, নিজে নিজে গায়ে পড়ে যারা উপকার করতে আসে তাদের কুমতলব কি বুঝি না ভেবেছ ? আমি সাধে না বলি পারত পক্ষে কারো দান গ্রহণ না করতে। বিমল বলল, দাও এবার দানের প্রতিদান ফিরিয়ে দাও?

আজকের পর যদি দেখি আর আমার পিছু নিয়েছো তাহলে তার প্রতিশোধ আমি নেবই। বিমল বলল, ‘আজকের পর তো আমি আর পিছু হটবো না। তাহলে?’

আমাকে ঘরে ঢুকতে দাও তাহলে কি সেটা ঘরে ঢুকেই বলব। মিতুর মা অনেকক্ষণ দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকে এইমাত্র ঘরে ঢুকল। সাথে সাথে বেল দিল মিতু। মাকে ডেকে ডেকে ঘরের ভিতর ঢুকে ঝপ করে দরজা বন্ধ করে দিল সে। সামান্য ভদ্রতাটুকুও দেখাল না বিমলকে । মা জানতে চাইল ‘এ কে?’ তার উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করল না সে। মিতুর মা পিছন ফিরে বিমলকে বলল বাবা বস। আজ এত রাত হয়ে গেল, এত রাতে তো সে কখনো আসেনা। আজ এমন কি হয়েছিল? আর তুমি কে? মিতুর মাকে প্রণাম দিয়ে বলল, আমার নাম বিমল। আজ মিতু শেষের ট্রেনটি ফেল করেছিল। ভাগ্যিস আমি ঐ ট্রেনে ছিলাম তাই সে উঠতে পারেনি দেখে আমি চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে অটো করে আপনাদের বাড়ি পর্যন্ত এসে গেলাম।

ওমা! তুমি তার এত ভাল বন্ধু ছিলে কই সে তো কখনো তোমার কথা আমাকে বলেনি? বিপদেই তো বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়।

এতক্ষণ আড়ালে থেকে মা আর ওর সব কথা শুনে মনে মনে আবারও মিতু বলল, সত্যিই তো ও না থাকলে আমার এতক্ষণে কি কি হতে পারত। আজকাল রাস্তাঘাটের যা অবস্থা গাড়িতে বাড়িতে কোথাও নারীর নিরাপত্তা নেই।

এমন সময় সে বলে উঠল ‘মাসি আমি আসি তাহলে।’ তার চলে যাওয়ার কথা শুনে মনটা হঠাৎ হু হু করে উঠল কেন! তাহলে কি আমিও তাকে এই কয়েক মিনিটে ভালবেসে ফেলেছি ?

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাসুল (দ.) এর পদাঙ্ক অনুসরণে উভয় জগতের মুক্তি নিহিত
পরবর্তী নিবন্ধনারীশক্তি-শেকল ভেঙে শিখরে