পঁচাত্তর ট্রাজেডির পর বিদেশে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তারপর দেশে ফিরে ধরেছিলেন দলের হাল। এরপর চার দশক ধরে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি।
এবার ২২তম সম্মেলনের আগে নতুন কমিটি নিয়ে আলোচনায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। গতকাল অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তাই ঘটেছে, টানা দশমবার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন শেখ হাসিনা, যিনি প্রধানমন্ত্রী পদে চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে টানা তৃতীয়বার সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গী করেছেন কাউন্সিলররা। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর দলের বিংশতম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জায়গায় আসেন কাদের। এরপর ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ২১তম সম্মেলনে একই পদে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
সকালে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন উদ্বোধনের পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বসে কাউন্সিল অধিবেশন। নির্বাচনী অধিবেশনে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক সভাপতি পদে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করেন। তা সমর্থন করেন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। সাধারণ সম্পাদক
হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করেন নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাধন চন্দ্র মজুমদার। তা সমর্থন করেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুন।
নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে গঠিত তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন সভাপতি পদে শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক পদে কাদেরের নাম কাউন্সিলরদের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেন। সারা দেশ থেকে আসা সাড়ে ৭ হাজার কাউন্সিলর সমস্বরে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। ফলে দশমবার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
৭৫ বছর পেরিয়ে আসা শেখ হাসিনা এর আগে বিভিন্ন সময় বয়সের বিষয়টি তুলে ধরে দলীয় পদ থেকে অবসর নেওয়ার কথা বলেছিলেন, তবে নেতা–কর্মীরা তাকে ছাড়তে চাইছেন না। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা তৃণমূলের নেতাদের কথায় স্পষ্ট হয়, তাদের ভরসার জায়গা শেখ হাসিনাই।
সামনে নির্বাচন, বিরোধীরা একদিকে রাজপথ উত্তপ্ত করার পথে এগোচ্ছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সরকারকে ফেলেছে চাপে। এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে দলের সম্মেলনে ফের সভাপতি হলেন শেখ হাসিনা। তবে তার সভাপতি পদে আসাটা এবং রাজনীতিতে পথে চলাটাই ঝঞ্ঝামুখর। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্ত আর সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যখন চরম সংকটে, তার কয়েক বছর পর ১৯৮১ সালে বিদেশ থেকেই দলের হাল ধরেন তিনি। এরপর ৪১ বছর ধরে রাজনৈতিক নানা পটপরিবর্তন ও চড়াই–উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে পরিবর্তন এলেও সভাপতি পদে বিকল্পহীন হয়ে উঠেন তিনি।
রাজনীতিতে বন্ধুর পথ : জন্ম থেকেই রাজনীতিতে শেখ হাসিনা। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজিলাতুননেছা মুজিবের ঘরে বড় সন্তান হিসেবে জন্ম তার। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করেন। দুই বছর পর ১৯৬৭ সালে তৎকালীন সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেখ করেন।
১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বিয়ের কারণে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ছেদ পড়ায় তাকে স্নাতকের পাঠ স্থগিত রাখতে হয়। পরে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। রাজনীতিতে শেখ হাসিনার হাতেখড়ি ছাত্রলীগ দিয়ে, ১৯৬৬–৬৭ সালে কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কিন্তু দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার কর্মসূত্রে জার্মানিতে ছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা গিয়েছিলেন বোনের কাছে বেড়াতে। দেশে স্বজনদের হারিয়ে এরপর নির্বাসিত জীবন শুরু হয় শেখ হাসিনার, আশ্রয় পান ভারতে। তখন ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগকে এক করতে ১৯৮১ সালে দলের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন তিনি। শুরু হয় রাজপথে তার সংগ্রামী জীবনের পথ চলা।
বাংলাদেশের মানুষের প্রতিটি আন্দোলন–সংগ্রামে সামনে থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ১৫ দল নিয়ে জোট গঠন করে আন্দোলন করেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বর মাসে তাকে গৃহবন্দি করা হয়। পরের বছর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্তও তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে পার্লামেন্ট থেকে ইস্তফা দেয় আওয়ামী লীগ সদস্যরা।
১৯৯০ সালে তিন জোটের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা। সম্মিলিত সেই আন্দোলনে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়েন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর সভাপতির দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা; তবে নেতা–কর্মীরা তাকে ছাড়েননি বলে পদে থেকে যেতে হয় তাকে। ১৯৯৬ সালে ভোটে জিতে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আবারও বিরোধীদলে যান শেখ হাসিনা। বিএনপির শাসনামলে তখন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেওয়ার শেষ পর্যায়ে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলে ও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়। মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণের মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিন–চতুর্থাংশ আসনে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর তার নেতৃত্বে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এখন টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে তিনি।
ওবায়দুল কাদেরের হ্যাটট্রিক : ওবায়দুল কাদেরকে টানা তৃতীয়বার সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গী করেছেন কাউন্সিলররা। সভাপতি পদে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় এবারও কাউন্সিল ঘিরে সবার আগ্রহ ছিল সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। তবে শেখ হাসিনা নতুন কাউকে না নিয়ে পুরনো কাদেরই ভরসা রেখেছেন।
ওবায়দুল কাদেরের জন্ম নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি। বসুরহাট সরকারি হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় স্থান পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নেন।
কলেজজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত ওবায়দুল কাদের। ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থানে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুজিব বাহিনীর কোম্পানীগঞ্জ থানার কমান্ডার ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওবায়দুল কাদেরও বন্দি হয়েছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। পরপর দুবার এ পদে ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি ওবায়দুল কাদের এক সময় শেখ ফজলুল হক মনি প্রতিষ্ঠিত দৈনিক বাংলার বাণীতে কাজ করতেন।
২০০০ সালে সংস্কৃতি ও শিক্ষা সম্পাদক পদ পাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পান তখনকার যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কাদের। ছাত্রলীগের সভাপতি থেকে আওয়ামী লীগে নানা পদ পেরিয়ে সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের।
২০০৯ সালে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার আগে তিনি সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদেও ছিলেন। এর আগে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন তিনি।
এর আগে নির্বাচন করলেও ১৯৯৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কাদের। সপ্তমের পর নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনেও নোয়াখালী–৫ (কোম্পানীগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচিত হন তিনি। শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ২০১৩ সালে ওবায়দুল কাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তার সময়ে মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তিত হয় ‘সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়’ নামে।
২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদের সরকারেও ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দ্বিতীয়বারের মতো কাদেরকে দেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগে সর্বাধিক টানা চারবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিল্লুর রহমান। তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তারপর ওবায়দুল কাদেরই তিনবার সাধারণ সম্পাদকের পদ পেলেন।