শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

মানবতাবিরোধী অপরাধ । ট্রাইব্যুনালের শুনানি টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার

| সোমবার , ২ জুন, ২০২৫ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

জুলাইআগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা উল্লেখ করে যে ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে, তা আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আলমামুনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউসনের পক্ষ থেকে ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ ১ : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আসামী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধগুলো সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগ ২ : আসামি শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্রজনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আলমামুন কর্তৃক আসামি শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে, যা তাদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।

অভিযোগ ৩ : শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আলমামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের দ্বারা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অভিযোগ ৪ : শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আলমামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্রজনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগ ৫ : শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে হত্যার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আলমামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্রজনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং ১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

প্রসিকিউসনের পক্ষ থেকে গতকাল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনের পর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল১ শেখ হাসিনাসহ অপর দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেওয়ার আদেশ দেন। সেই সাথে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১৬ জুন দিন ধার্য করেন। এই মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে সেদিন আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। দুপুর ১২টায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন শুরু হলে তা সরাসরি সম্প্রচার করে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি।

শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্র্যাইব্যুনালকে বলেন, মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। যেখানে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রটি ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। গতকাল ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউসনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও মো. আব্দুস সোবহান তরফদার শুনানি করেন। এ সময় অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের বিষয়টি নিয়ে শুনানিতে সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইআগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশসহ বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

১২ মে চিফ প্রসিকিউটর বরাবর এই অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সে প্রতিবেদন যাচাইবাছাই শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে গতকাল ট্রাইব্যুনালে তা দাখিল করার পর উপস্থাপন করা হয়।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরো দুটি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুমখুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। জুলাইআগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। এসব অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগরীতে আজও ভারি বৃষ্টির আভাস
পরবর্তী নিবন্ধফইল্ল্যাতলীতে এক ফুট গভীরে দেবে গেছে সড়ক