শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু আস্থার অক্ষয় জ্যোতি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২৫ জুন, ২০২২ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ


জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা উচ্চারণে নিবন্ধের সূচনায় জাতীয় কবি নজরুলের কবিতার পংক্তি ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কা-পুরুষ লড়ে যায় বীর’ উপস্থাপন করতে চাই। অবিচল আত্মবিশ্বাস ও আস্থার সাথে দেশীয়-আন্তর্জাতিক-কথিত উন্নয়ন সহযোগীদের বহুবিধ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে আজ দেশরত্ন শেখ হাসিনার ‘আমরাও পারি’ সংকল্পের বিজয়ের দিন ২৫ জুন ২০২২। বহুল প্রতিক্ষীত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতুর শুভ উদ্বোধন। এই সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেকোন ধরনের অন্ধকারের অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে লালসবুজের পতাকাকে গৌরবোজ্জ্বল রাখার শক্তিমানতায় যে ঋদ্ধ; নতুন করে তা আবার প্রমাণিত হলো। ইতিমধ্যে মাঙ্গলিক এ সেতু তিনটি ক্ষেত্রে তথা- চল্লিশ তলার সমান পাইলিং, দশ হাজার টনের বেশি ধারণ ক্ষমতার বেয়ারিং এবং নদী শাসনে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর সরকারকে খাটো করার অপচেষ্টা করেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্নের জয়ধ্বনিতে বিশ্ব আজ মুখরিত। এই গৌরবগাথায় প্রতিহিংসাপরায়ণ পরাজিত কুচক্রীমহল এখন নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতিসহ বহুলাংশে সেতু নির্মাণ শৈলীতে প্রযুক্তি-সুবিধা সংযোজনের যৌক্তিক কারণে ব্যয়ের পরিমাণ কিছুটা বেশি হয়েছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য দেশের উন্নয়ন বিরোধীচক্র পদ্মা সেতুতে অনেক বেশি অর্থ খরচ হওয়ার তকমা লাগনোর অপকৌশলে ব্যতিব্যস্ত।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে; প্রাথমিক পর্যায়ে যে ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর প্ল্যান করা হয়েছিল, তাতে ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ছিল মোট ২ হাজার ২৬৭ একর। কিন্তু বাস্তবে অধিগ্রহণ করতে হয়েছে ৬ হাজার ২৪১ একর। ফলে জমি অধিগ্রহণ তিনগুন বেড়ে যায়। এছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ জনগণকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে ক্ষতিপুরণ বাবদ বরাদ্দ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আইন পরিবর্তন করে তা তিনগুন বাড়িয়ে দেন। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সেতুর নিচ দিয়ে বড় জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে মাত্র ৩টি স্প্যান উঁচু করে বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হলেও পরবর্তীতে ৪১টি স্প্যানই সমউচ্চতায় বসানো হয়েছে। সেতুর দৈর্ঘ্যও ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। করতে হয়েছে খরস্রোতা নদী পদ্মার দীর্ঘ ১৬ কিলোমিটার পাড় নিয়ে নদী শাসন। প্রাথমিক ডিজাইনে গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইন নেওয়ার পরিকল্পনা না থাকলেও পরে এ দুইটি লাইন সংযুক্ত হয়। সর্বোপরি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সার্বিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির মিথ্যা অভিযোগ নিতান্তই অযৌক্তিক বা অমূলক – নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।

জাতিকে পদ্মা সেতু উপহার দেওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে ৮ জুন জাতীয় সংসদে আনা প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তারা ভেবেছিল পদ্মা সেতু ইস্যুতে আমরা আত্মসমর্পণ করবো; কিন্তু না। আমি মুজিবের মেয়ে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করি না। শেখ হাসিনা দেশের মানুষের মাথা হেঁট করে কোনো কাজ করবে না। কোনোদিন করেও নি। পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশল জগতে এক বিস্ময়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি পদ্মা সেতু আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। টেকনোলজি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের জ্ঞান বেড়েছে। আমরা ভবিষ্যতে আরও অনেক উন্নত কাজ করতে পারব। পৃথিবীতে এই ধরনের স্ট্র্যাকচারের সেতু আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি।’ এসময় তিনি মহান আল্লাহর শোকরিয়া জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিশেষ করে যেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এসেছিল। তাদের অনেকগুলো চেক ভাঙানোর প্রয়োজন না হওয়ায় তিনি স্মৃতি স্বরূপ তাঁর কাছে সংরক্ষণ করে রাখার বিষয়টিও মহান সংসদে উত্থাপন করেন।

দ্য ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্স অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোটার্স ফোরাম (আই আর এফ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীত ফেলো জনাব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের অকাঙ্ক্ষা-আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে করেছি। কিন্তু আমাদের এখন সমান্তরাল উদ্যোগগুলো নিতে হবে। কারণ পদ্মা সেতু শুধু ট্রান্সপোর্ট করিডোর নয়। আমরা এটিকে অর্থনৈতিক করিডোর করতে চাই। উক্ত আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদরা পদ্মা সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক করিডোর গড়তে বিনিয়োগ বাড়ানোর দূরদর্শী উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উৎসাহিত করতে সরকারিভাবে নেওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে এতদ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে মহাসড়কের পাশে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার ব্যবস্থা, সেতুর উভয় পাশে গ্যাস সংযোগ, দক্ষিণে বিসিক শিল্পনগরীগুলো চালু ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্প্রসারণসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প স্থাপনের সহায়ক নীতি গ্রহণ, মাশুল আদায়ে স্বয়ংক্রিয় ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রবাহে ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপন, মাস্টার প্ল্যানের আওতায় সেতুর উভয় পাশে উন্নয়নের ব্যবস্থা, পৃথক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, নদীর উভয় পাশে ইকোপার্ক স্থাপন এবং পদ্মার পাড়ে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের একটি অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী’।

দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের মতে পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণের জেলার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে। সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালের মে মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) মাদারীপুর, শরীয়তপুর এবং মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপর পরিচালিত সমীক্ষায় ৯৫ শতাংশ ব্যক্তি পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিপণ্যের পরিবহন সহজ হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। সেতু বিভাগের সূত্রমতে, পদ্মা সেতুর কারণে বদলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। সরাসরি উপকৃত হবে মানুষ। নতুন গতি পাবে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠবে কৃষি-মৎসনির্ভরসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পর্যটনকেন্দ্র। কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটবে বেকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। সেতুটি শুধু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই সমুদ্রবন্দর মোংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে যোগাযোগ সহজ হবে। কয়েক গুন বৃদ্ধি পাবে মোংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য। পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে সারা দেশের মানুষ।

আমাদের সকলের জানা যে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতার মুকুন্দপুর এলাকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম করা যে ৭-৮টি হাসাপাতাল রয়েছে প্রতিদিন তাতে গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার বাংলাদেশী রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। কলকাতার চিকিৎসকদের মতে, পদ্মা সেতু চালু হলে পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি তাদের ব্যবসা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া কলকাতার চিকিৎসা খাতেও পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে স্বীকার করেছেন সিটি অব জয়ের শীর্ষ স্থানীয় চিকিৎসকরা। সেতু চালু হলে মুমূর্ষু রোগীরা এক যানবাহনেই সীমান্তে পৌঁছনোর সুযোগ পাবেন। ফলে বাংলাদেশি রোগীরা স্বস্তিতে সেবা নিতে পারবেন। যানবাহন ও সীমান্তের চরম দুর্ভোগের মধ্যে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাওয়া রোগীরাও পদ্মা সেতু খোলার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, কলকাতায় আসতে অনেক সময় ব্যয় হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে আরও অনেক কম সময়ে এখানে আসতে পারব।

গত ২ জুন পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত ‘ডেইলি টাইমস’ পত্রিকায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করে পদ্মা সেতুর গল্প নিয়ে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক’র এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। উক্ত নিবন্ধে ড. মালিকা উল্লেখ করেন, ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বদলে যাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। উন্নত হবে যাতায়াত ও পর্যটন খাত। সমৃদ্ধ হবে ব্যবসা-কৃষি ও শিল্পখাত। দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগের অবসান হবে। তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।’ এই বক্তব্যের সাথে শতভাগ সহমত পোষণ করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার দেশপ্রেম-প্রজ্ঞা-মেধা-দূরদর্শীতা-দেশবাসীর কলাণে অপ্রতিরোধ্য দুঃসাহসিক কর্মকৌশল দেশকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নেবে। আজকের এই দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘায়ু প্রার্থনা, সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অপরিমেয় ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর প্রাক্তন মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট সকল নির্মাণ শ্রমিক-প্রকৌশলী-কলাকুশলী এবং দেশের আপামর জনসাধারণের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাহস ও সততার পদ্মা সেতু স্বপ্নসারথি শেখ হাসিনা
পরবর্তী নিবন্ধমতামত : পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা