শিশু। তাকে বলা হয় পৃথিবীর সোনালি আশা। তাকে নিয়ে এই পৃথিবীতে রচিত হয়েছে হাজার হাজার কবিতা। হাজার হাজার গান। নির্মিত হয়েছে নাটক, সিনেমা। তার ভেতরে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা। তাই তাকে ভাবা হচ্ছে ‘শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ’ হিসেবে। আমাদের দেশে শিশুর ভবিষ্যত নিয়ে বলতে গেলেই একটি কবিতার লাইন উঁকি দিয়ে যায় মনের কোণে। সেটি হলো : ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’
সে আজ শিশু। ছোটো। আগামীতে সে বড় হবে। হবে বড় বৃক্ষের মতো। না, বৃক্ষ বললে মনে হয় তাকে যথাযথ বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় না। সে পরিণত হবে বিশাল মহীরূহে। পৃথিবীর আগামী দিনের ভবিষ্যত নির্ভর করছে তার ওপর। তাকে বড় হতে হবে। তার চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। তাকে বলা হচ্ছে কুঁড়ি। নতুন কুঁড়ির মতো সে। সুন্দর বাগানে যেন ফুল হয়ে ফোটার অপেক্ষায় আছে। আহা, তার কথাইতো বলেছেন কবি :
আমার নতুন আমরা কুঁড়ি
লিখিল বন নন্দনে
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা
জীবন জাগে স্পন্দনে।
বড়রা তাকে নিয়ে ভাবনায় অস্থির। পৃথিবীতে এ জন্য স্লোগান তৈরি হয়েছে ‘সবার আগে শিশু’। যাঁরা সমাজের অভিভাবক, তাঁদের অনেক দায়িত্ব। তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে বলছেন ‘শিশুরা আগামী দিনের আলো।’ বাংলা ভাষার আরেক মহান কবি অনেক আগেই সমাজের দায়িত্বের কথা বলে গেছেন :
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংসসতূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
পৃথিবীর জঞ্জাল সরিয়ে শিশুকে তার বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার গ্রহণ খুবই জরুরি। কেননা, অনেকের প্রত্যয় ভরা কণ্ঠে শিশুর সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও সে এখনো নির্যাতনের শিকার। সে অবহেলিত। সুবিধা বঞ্চিত। কোথাও কোথাও সে তার স্বাভাবিক কাজে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কোথাও না কোথাও সে অপমানিত হচ্ছে। কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিতে হচ্ছে। ফলে গোটা পৃথিবী আজ তার জন্য নিবেদিত। সব কটি দেশে শুরু হয়েছে বিশ্ব শিশু আন্দোলন। তার অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে বৃদ্ধি পাচ্ছে জন-সচেতনতা। শিশুর প্রতি নির্যাতন ও অবহেলার বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছে জনমত। নেওয়া হচ্ছে সামাজিক উদ্যোগ। বিশ্বের এক জননন্দিত মহানায়ক-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘যে জাতি শিশুদের কথা ভাবে না, সেটা কোনো জাতিই নয়।’ তাই বলা যায়, একটি জাতিকে যদি অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই দরকার শিশুর পরিচর্যা। মেধায় মননে শক্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে।
শিশুর মৌলিক অধিকার বিষয়ে সোচ্চার জাতিসংঘ। প্রণয়ন করা হয়েছে শিশু অধিকার সনদ। এটি জাতিসংঘের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। মোটা দাগে আমরা বলতে পারি, শিশুর অধিকারগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক. বেঁচে থাকার অধিকার। দুই. বিকাশের অধিকার। তিন. সুরক্ষার অধিকার। চার. অংশগ্রহণের অধিকার।
আর সব কিছু ভুলে গেলেও মনে হয়, এ চার অধিকারের ব্যাপারটি ভুলবার নয়।
সে শিশু। পদে পদে আজ সে বঞ্চিত। সে এগোতে পারে না। তার অনেক বাধা। তার ভালোভাবে বাঁচা দরকার, পড়াশোনা করা দরকার, খেলাধুলা করা দরকার। কিন্তু সবসময় সে হাসিখুশি থাকতে পারে না। খেলতে পারে না। তার খেলার জন্য মাঠই নেই। তাই তার সাহায্য এগিয়ে আসছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এগিয়ে আসছে সরকার। এগিয়ে আসছে রাষ্ট্র। শিশুকে সুন্দরভাবে বাঁচানোর জন্য, স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পথকে মসৃণ করার জন্য তারা তৎপর। তার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য নানা কর্মসূচি আজ আমরা দেখি। তার প্রতি সহানুভূতিশীল সবাই। আদর, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে বড় করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। কেননা, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের ওপর নির্ভর করে গোটা জাতির কল্যাণ। সে বড় হোক উদ্দীপনার মাঝে, হয়ে উঠুক আত্মবিশ্বাসী। তার চোখে অবারিত স্বপ্ন। সে হোক স্বপ্ন-রাজ্যের দুরন্ত রাজকুমার।
আমরা জানি, প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্ব শিশু দিবস পালন করবে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালন করা হয় দিবসটি। সে হিসাবে এবারও আগামী ৩ অক্টোবর সোমবার সারাদেশে পালন করা হবে বিশ্ব শিশু দিবস। তবে বাংলাদেশ সরকার একইসঙ্গে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে পালন করে শিশু অধিকার সপ্তাহ। এবারও সেই বিষয়ে প্রস্তুতি রয়েছে বলে আমরা অবগত আছি।
এই ‘শিশু অধিকার সপ্তাহ’র উদ্বোধন নির্দিষ্ট তারিখে হয় না। সরকারের সুবিধা মতো সময়ে সেটার আয়োজন হয়ে থাকে। যেমন ২০২১ সালে ‘শিশু অধিকার সপ্তাহ’ পালন হয়েছে ৪ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত; ২০২০ সালে শিশু অধিকার সপ্তাহ উদ্বোধন হয় ৫ অক্টোবর; ২০১৯ সালে উদ্বোধন হয় ৯ অক্টোবর; ২০১৭ সালে শিশু অধিকার সপ্তাহ শুরু হয় ১১ অক্টোবর। ্ল্ল্ল্লএখানে উল্লেখ করতে পারি, সকল শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রত্যয়ে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাজানো হয় শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপনের কর্মসূচি।
আমরা অবশ্যই অবগত আছি যে, আমাদের শিশুদের ভালোবাসার প্রতীক শেখ রাসেলের জন্মদিন ১৮ অক্টোবর। তাই এই দিনটাকে রেখে শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা গেলে সামগ্রিকভাবে এই সপ্তাহ পালনের সার্থকতা আসবে বলে আমরা মনে করি। একটি জাতিকে যদি অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই দরকার শিশুর পরিচর্যা। মেধায় মননে শক্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে।
বেঁচে থাকার অধিকারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। শেখ রাসেলকে হত্যা করে তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করেছে ঘাতকরা। এজন্য আমাদের সরকারের কাছে আবেদন জানাতে চাই, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনকে রেখে শিশু অধিকার সপ্তাহ পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হোক। ১২ অক্টোবর শিশু অধিকার সপ্তাহ উদ্বোধন হলে ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনটা শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হবে নিঃসন্দেহে। এ লক্ষ্যে গত ৩০ আগস্ট আমি বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির পক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিবের কাছে তাঁর মন্ত্রণালয়ে লিখিত আকারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেছি। মাননীয় সচিব সেটাকে ‘উত্তম প্রস্তাবনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং সে-বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাব্রতী মো. মাজহারুল হক। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে ‘শেখ রাসেল ছোটোদের বইমেলার’ আয়োজন করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের প্রতি আবেদন, বিষয়টি সুবিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমাদের, বিশেষত শিশুসাহিত্য কর্মীদের কৃতার্থ করবেন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো, বাংলা একাডেমি।