শেকল ছেঁড়ার দিন

মহান মে দিবস আজ

ঋত্বিক নয়ন | সোমবার , ১ মে, ২০২৩ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড় / পাহাড় কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড় / তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি / তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাইল ধূলি / তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান।’দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই মেহনতি মানুষের জয়গান গেয়েছেন তাঁর ‘সাম্যের গান’ কবিতায়। তবু এ কথা অনস্বীকার্য যে আজও হাড় ভাঙা খাটুনির পর মজুরি নিতে এসে কখনো আগুনে পুড়ে কখনোবা ভবন ধসে মরতে হয় তাদের। ন্যায্য মজুরি চাইতে গেলেই ভয় থাকে চাকরি ছাঁটাইয়ের, ক্ষমতাশালী মালিকের পেটোয়া বাহিনী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে হামলে পড়ে তাদের ওপর। এভাবেই চলছে। তাদের কেউ শাবল, কেউ হাতুড়ি পেটানো মানুষ, ভাঙছেগড়ছে, বানাচ্ছে আকাশ ছোঁয়া ভবন। আবার কেউ সূঁইসূতায় ফোঁড় তুলে তৈরি করছে মানুষের পরিচ্ছদ, ভোরে তাদের কারও হাঁকডাক কিংবা চায়ের কাপ ধোয়ার শব্দে ঘুম ভাঙে নগর সভ্যতার ধারক, বাহকদের। তারা শ্রমিক, তারা সভ্যতার নির্মাতা।

সমাজের এই শ্রমিক শ্রেণী ঘাম আর শ্রমের জন্য নতুন সভ্যতার সোপান গড়ার কাজে যেমনি এগিয়ে আছে, তেমনি মৃত্যুর মিছিলেও এগিয়ে থাকছে তারাই। এমনি এক দুঃসময়ে বছরের চাকা ঘুরে আবারো এসেছে আজ পহেলা মে; মহান মে দিবস। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের সংহতি প্রকাশের দিন আজ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে যারা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আজ। ‘এই পতাকা শ্রমিকের রক্ত পতাকা / দিক নিশানা সংগ্রামের মুক্তি পতাকা / এই পতাকা ঐক্যের, মুক্তির ও শক্তির / শুভ্র রাঙা বিপ্লবের অরুণ পতাকা।’বিপ্লবী শ্রমিকের হাতুড়ির দৃঢ় কারুকাজে সজ্জিত ঘামে ভেজা রক্তাক্ত একটি দিন পহেলা মে। ১৮৮৬’র ১ মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেটে মজুরের তাজা খুনে রাঙা রাজপথ ধরে লাল ঝান্ডা উড়িয়ে মেহনতি মানুষ নিজের অধিকার বুঝে নিয়েছিল। মে দিবসের সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেণীকে উপহার দিয়েছে সংগ্রামী লাল পতাকা ও মুষ্টিবদ্ধ হাত। শ্রমিক শ্রেণীর জন্য আজকের দিনটি তাই দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হওয়ার দিন, শেকল ছেঁড়ার দিন, উৎসবের দিন, একই সাথে শোকেরও দিন। আজ সরকারি ছুটির দিন।

১৮৮৬ সালে আজকের দিনটিতে শিকাগোর ১ লক্ষ ৮৫ হাজার শ্রমিক বিশেষ করে রাজমিস্ত্রিরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ে আন্দোলন করে। ২ মে রোববার ছুটির দিন ধর্মঘট লাভ করে ব্যাপকতা। ৩ মে ম্যাক কর্মিক ফসল কাটা কারখানায় সভা চলাকালীন সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করলে শ্রমিকরা প্রতিহত করে। শ্রমিকদের ওপর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছয় শ্রমিক। আহত হয় অনেকে। পাশেই কাঠ চেরাই কারখানায় আরেকটি সভায় বক্তৃতা করছিলেন শ্রমিক নেতা স্পাইজ। তিনি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাথীদের সাথে পরামর্শ করে পরদিন প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করেন। ৪ মে সেই প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেয় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। রাত তখন ১০ টা। শেষ বক্তা ফিলডেন বক্তৃতার ইতি টানছেন, এমন সময় ওয়ার্ড নামে একজন পুলিশ সার্জেন্ট সমাবেশ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। একই সময় সমাবেশ স্থলে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুলিশের এক সোর্স বোমাটি বিস্ফোরণ করে। সাথে সাথে নির্বিচারে শুরু হয় গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জ। ঘটনাস্থলে ৪ শ্রমিক নিহত হয়। রক্তে ভিজে যায় ‘হে’ মার্কেট চত্ত্বর।

১৮৮৮ সালের ১ মে আবারো ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ৩ মে পুলিশের গুলিতে এক কিশোর শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। তার সাদা শার্টটি রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্তে রঞ্জিত শার্টটি একটি কঞ্চিতে তুলে ধরে শ্লোগান দিতে দিতে দৌঁড়াতে থাকে গুলিবিদ্ধ কিশোরটি। এর আগে পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর পতাকা ছিল সাদা, শান্তির প্রতীক। সেদিন থেকে কিশোরের রক্তে রাঙা লাল শার্টটিকে প্রতীক হিসেবে ধরে শ্রমিক শ্রেণী লাল পতাকাকে বরণ করে নেয়। ৩ মে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের গণকবর দেয়া হয়। রাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সকালে দেখা যায় বৃষ্টির পানিতে কবরের মাটি সরে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ একটি হাত বেরিয়ে এসেছে। শ্রমিকেরা মনে করে এ মুষ্টিবদ্ধ হাত তাদেরকে সংগ্রাম না থামানোর নির্দেশ দিচ্ছে। সেই থেকে শ্রমিক শ্রেণী যখন কোনও সংগ্রামী শপথ গ্রহণ করে তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে শপথ করে। বিশ্বের সকল দেশে শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্তটা নেয়া হয় ১৮৯০ সালে। সেই থেকে এই দিনটিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশের মেহনতি মানুষ ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে ধর্মীয়, ভাষাগত, আচার আচরণগত ভেদাভেদ ভুলে এক পতাকাতলে এসে জড়ো হয়। সমস্বরে আওয়াজ তোলে, ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই করো। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। এই লড়াই দাবি আদায়ের, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।’

শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রতীক মহান মে দিবস। শ্রমিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক অধিকার সুসংহত ও স্বার্থ রক্ষার সংগ্রাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার ঐতিহাসিক দিন ১ মে। এমন একটি সময়ে মে দিবস পালিত হচ্ছে, যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল সামলাতে গিয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে মেহনতি জনতাকে। গার্মেন্টস শিল্প কারখানাতে শ্রমিক অসন্তোষ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া মিল কারখানায় লোকসান দেখিয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ে সিদ্ধহস্ত মালিকপক্ষ একটাই চিন্তা করে থাকে; আজ একজন দক্ষ শ্রমিককে দশ হাজার টাকা মজুরি দেয়ার চেয়ে সে টাকায় পাঁচজন অদক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ দিয়ে কাজ চালাবে! শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে, আছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, কিন্তু নিজেদের জীবন মানোন্নয়নে পরিবর্তন নেই নারী শ্রমিকদের। পুরুষের পাশাপাশি নারীর মজুরি বৃদ্ধি পেলেও ঘোচেনি মজুরি বৈষম্য। একই ভাবে পরিবহন সেক্টরও জিম্মি হয়ে পড়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিয়োগপত্র প্রদান, কর্মঘণ্টা ও ছুটির অধিকার আজও কার্যকর হয়নি। চট্টগ্রামে পরিবহন শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময় ধর্মঘট আহ্বান করা হলে বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনারসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে নেতৃবৃন্দের সাথে সভা করেন। সে অনুযায়ী পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়িত হয় না।

মহান মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমিকমালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তা ও সুস্থতাসহ সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই।

মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মেহনতি মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার মালিকশ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন২০১৮’ প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে।

মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মহান মে দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দিনটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ও টকশো সম্প্রচার করবে।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ..ম নাছির উদ্দীন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, শ্রমজীবী জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে বর্তমান শ্রমিক বান্ধব সরকার সচেষ্ট। কেননা শ্রমিক শ্রেণী কঠিন দুর্বিপাকে অর্থনীতির চাকাকে চলমান রেখেছেন।

মহান মে দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম. মনজুর আলম বাংলাদেশের সকল শ্রমজীবীদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

আজ বিকেল ৩টায় নাসিমন ভবনস্থ বিএনপি কার্যালয়ের সামনে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের সমাবেশ ও র‌্যালি অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান উপস্থিত থাকবেন।

মে দিবস উপলক্ষে নগরীর চেরাগী চত্বরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গণসংগঠনের সম্মিলিত মোর্চা ‘মে দিবস উদযাপন পরিষদ’। এতে সভাপতিত্ব করবেন পরিষদের আহ্বায়ক ডা. চন্দন দাশ। বিকেল তিনটায় এ অনুষ্ঠান শুরু হবে। অনুষ্ঠানে আলোচনা সভা ছাড়াও মোর্চাভুক্ত সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আবৃত্তি, গণসঙ্গীত, নৃত্য, নাটকসহ একক ও দলীয় পরিবেশনা থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিনির বাজারে নৈরাজ্য
পরবর্তী নিবন্ধ৪ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প সিডিএর