মাটির পৃথিবীতে মাটির মানুষ জন্মের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রকৃতির বন্ধন থেকে চিরন্তনতায় পৌঁছে যায়। গগণের উদারতা, স্বর্গের শান্তির বাণী থেকে সত্যের ঘরে আতিথ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমার শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন মজনু পার্থিব জীবনের ক্রীড়া, কৌতুকময় বিশ্ব থেকে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। মহান আল্লাহ্ আমাদের এ শ্রেষ্ঠ ভাইটিকে জান্নাতের উচ্চ আসন দান করুন, আমিন। বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে স্বপ্নবান প্রিয় মানুষ, আমাদের অনেকের মানসিক, মানবিক ও স্বপ্নের উৎস, দৈনিক আজাদী পরিবারের অকৃত্রিম সুহৃদ, জনপ্রিয় কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও গবেষক এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে গেছেন। যে শূন্যতা পূরণ হবার নয়। স্বপ্নবিহীন বেড়ে ওঠা মানুষের অধিকার এবং ভবিষ্যত নিয়ে কাজ করেছেন গোটা জীবন। হতাশা, বঞ্চনা, পরাজয় এবং অপমানের মধ্যেও জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন, প্রতিজন মানুষের মধ্যে জাগরণের সুর। হৃদয়ে স্বপ্ন বাজিয়ে সুর তুলবার চেষ্টা করেছেন বাঁশিতে। গোটা জীবন আমাদেরকে শিখাতে চেষ্টা করেছেন, দয়ালু হবার, দেশের জন্য স্বার্থত্যাগ, দেশপ্রেম, সুন্দর সর্ম্পক স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং দায়িত্ববোধ।
একবিংশ শতকের এ কদর্যপূর্ণ সময়ে যেখানে জীবনের একমাত্র দর্শন লাভ আর লোভ। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার এ ভাইটি বিশ্বাস, ভালোবাসা, অন্তরে পবিত্রতা, আত্নার মহত্ত্ব, ধৈর্য, ক্ষমা, নম্রতা, সুরুচি হৃদয়ে ধারণ করে মিশেছেন এ শহরের স্বজন, প্রিয়জন, বন্ধুজন, প্রতিজন মানুষের সাথে, হয়তো এ কারণেই আজ সকলেই তাঁকে স্মরণ করে চলেছেন হৃদয়ে গভীর থেকে। আমাদের পরিবার, আপনাদের সকলের কাছেই চির কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর লেখনি, সমাজকর্ম এবং গবেষণার মধ্য দিয়ে আর্তনাদ, যন্ত্রণা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, অত্যাচার, অনাচার, অন্যায়, নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি, নিরন্ন, অসহায়, বিপন্ন, ক্ষুধা, দারিদ্রতা পূর্ণ বেদনাময় মানুষের যাযাবর জীবনের কষ্টগুলোকে দূর করতে। নিজে কষ্ট করেছেন অথচ তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে সেই কষ্টের রক্তক্ষরণের যন্ত্রণার পদাবলীর ছাপ কোনদিনই আমরা দেখিনি। কেননা তিনি এ দেশের, এ শহরের, এ সমাজের অনেক গুণি মানুষের সাহচর্য পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম.এ মালেকসহ অসংখ্য সজ্জন, সুধীজন মানুষের সান্নিধ্য, যাঁদের সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই তাঁর আচরণ ছিলো জলপ্রপাতের মতো, স্বভাব ছিলো শুদ্ধ, কর্মছিলো তেজোদীপ্ত, বিপুল বিশাল ছিলো হৃদয়। তিনি ছিলেন আমাদের আত্মার নিঃশব্দ সঙ্গীত, যে সঙ্গীতের ভাষা আমরা নিবিড় ভাবে অনুভব করতাম, পাতার ফাঁকে বাতাসের নিভৃত চলাচলের মতো। তাঁর হৃদয়ে পথহারা, বঞ্চিত মানুষের জন্য যে হাহাকার তৈরী হতো, তা দেখে আমার ব্যাংকার বাবা মরহুম বেলায়েত হোসেন প্রায়ই বলতেন, যার জন্ম হবার কথা ছিলো শেরে বাংলার ঘরে, সেই ছেলে জন্ম নিলো আমার ঘরে! কথাটি এ কারণেই লিখছি, আমার বড় ভাই শিশু বয়সে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে এ রকম এক পথহারা, বঞ্চিত শিশুর কান্না দেখে সেই শিশুটিকে বাসায় নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে সেই শিশুটি রাশিয়ার তাসখন্দ থেকে পি.এইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আমার সেই ভাইটি ড.জয়নাল আবেদীন অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে বর্তমানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এ রকম উদ্ভাসিত সত্য, সুন্দর জীবনের গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। আমাকে প্রায় বলতেন, যতগুলো অনাথ ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করালাম তাদের প্রত্যেকের পিতার নাম লিখা উচিত ছিলো সাখাওয়াত হোসেন মজনু। তা হলে দেশে -বিদেশে আমার অসংখ্য সন্তান থাকতো। কিন্তু না, মানবিকতা কি বিনিময়ের মাধ্যম হতে পারে? পারে না।
আজ আমাদের পরিবারে যে মাতম তৈরী হয়েছে তাঁর অকাল প্রয়াণের মধ্য দিয়ে, এ রক্তক্ষরণ, নিঃসঙ্গতা কোনদিনই ফুরাবে না। মায়ের প্রতি মমতা ভালোবাসা এতো বেশী ছিলো যে, নিজেও ভালোবেসেছিলেন মাকে এ কারণেই কি!.. একইদিনে, একইসময়ে ১৮ই রমজান পহেলা মে ২০২১ শনিবার সকাল ৮টায় মায়ের মৃত্যুদিবসের দিনই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মা চলে যাবার সময় আমাদের ঘরে হাসনে হেনা ফুল ফুটেছিলো, যার ঘ্রাণ আমরা প্রাণ ভরে নিয়েছি। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর দিনেও আমার বাসায় ফুটেছে অসংখ্য বেলী ফুল, কী আশ্চর্য মিল, মা হোসনে আরা এবং সন্তান সাখাওয়াত হোসেন মজনুর মধ্যে। অবাক বিস্ময় মহান আল্লাহ্র কাছেই এর আত্নিক গূঢ় রহস্য, যা আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দৈনিক আজাদী পরিবার যথার্থই লিখেছেন, ‘লেখার খাতায় বইয়ের পাতায় অশ্রু ঝরে টুপ/ স্তব্ধ সবাই, পুরো শহর নিরালা নিশ্চুপ’। তিনি দৈনিক আজাদীতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩১ বছর সাপ্তাহিক কলাম ‘সাম্প্রাতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’ লিখে গেছেন।
ক্ষুধার্ত শিশুদের আর্তচিৎকার, বেঞ্চবিহীন গাছতলায় শিশুদের নিয়ে ছিলো তাঁর অসংখ্য ভাবনা। আমাকে প্রায়ই বলতেন, আমি ভিক্ষা করে অবহেলিত মানুষের চিরস্থায়ী ক্রন্দন দূর করতে চেষ্টা করে চলেছি। এ সমাজের বহু সজ্জন মানুষ তাঁকে সহযোগিতা করেছেন, আমরা তাঁদের সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ। নিজের জন্য কারো কাছে কখনো কিছুই চাননি। যদি চাইতেন- দেশ স্বাধীনের পর থেকে তিনি অর্থবিত্ত এবং বৈভবের একটা জীবন হয়তো পেতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তৎকালীন সরকার আমার বড় ভাইকে জীবিত অথবা মৃত ধরবার হুলিয়া জারি করেছিলেন। ঠিক ১৮দিন পর তৎকালীন সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান নিজ বাসভবন থেকে। একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, এ কারণেই আজ আপনারা সবাই যথাযথভাবে আমার এ ভাইটিকে ভালোবেসে চলেছেন। তাঁর অসমাপ্ত কর্ম, স্বপ্ন এবং ন্যায্য স্বীকৃতিটুকু দিয়ে চট্টগ্রামের সুধীজন ব্যক্তিবর্গ তথা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গের কাছে আমার আশা-প্রত্যাশা তাঁকে যেন মরনোত্তর স্বীকৃতিটুকু দিয়ে হলেও, সম্মানিত করা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে কলামিস্ট, নিষ্ঠাবান গবেষক, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, চট্টগ্রাম একাডেমির জীবন সদস্য, বরেণ্য সমাজ হিতৈষী, এক সময়ের ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট, নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. ইউনূস সুহৃদ সংগঠন, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ, চট্টগ্রাম কলেজ ফাউন্ডেশন, অমর একুশে বইমেলা চট্টগ্রাম, সম্প্রীতি ফোরাম চট্টগ্রাম কলেজ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ চট্টগ্রাম, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ স্মৃতি পরিষদসহ এ ধরনের অসংখ্য সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। আপনারা অনেক কিছুই জানেন, ইতোমধ্যে অনেক কিছু জেনেছেন, অনেক লেখকের লিখনির মধ্য দিয়ে। সংশোধনী : তাঁর মৌলিক গবেষণা ও সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ৩৭টি, আরো অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। সাখাওয়াত হোসেন মজনু নামের মূল্যায়ন তিনি যথার্থই করেছেন অর্থাৎ যিনি কি’না কলম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কলম দিয়ে তিনি ভালোবাসার কথা লিখেছেন নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মতো। “ যা লিখেছি সব তাদেরই জন্যে/ তাদেরই জন্যে, যারা মাটির পিঁপড়ের মত/ সমুদ্রের মাছের মত, আকাশে পাখির মত অগণিত,/ যারা ভীরু, যারা বীর/ যারা নিরক্ষর, যারা শিক্ষিত/ যারা শিশুর মত সরল”। (নাজিম হিকমত)।
লেখক : সাখাওয়াত হোসেন মজনুর ছোটো ভাই