আমাদের পরিবারে কঠোর অনুশাসন বলবৎ ছিল। এখনও আছে। পিতামহী (বাবার মা) ছিলেন পরিবারের প্রধান, পিতামহের জীবদ্দশায়ও। আব্বার কাছে শুনেছি তাঁদের ছেলেবেলায় বাড়িতে দাদুর কিছু গুপ্তচর নিয়োজিত ছিল। ছেলেরা কাছারি ঘরে ঠিকমতো লেখাপড়া করছে, না কি বন্ধুদের সঙ্গে অকারণে সময় কাটাচ্ছে বা ঘুমিয়ে পড়েছে, বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে না গিয়েও সে খবর পেয়ে যেতেন তিনি। বাড়িতে খেতে এলে নিয়ম ভঙ্গকারী তার শাস্তি থেকে রেহাই পেতো না। অপরাধের ধরন বুঝে বকুনি, বেত্রাঘাত অবধারিত ছিল অভিযুক্তের কপালে।
আমাদের শৈশবেও পরিবারের প্রধান দাদু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবা কেবলমাত্র মাতৃদায় মেটাতেই স্ত্রী-সন্তানদেরকে দূর গাঁয়ে ফেলে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছিলেন। দাদু ভাঁড়ার ঘরের চাবি মায়ের আঁচলে বেঁধে দেন। একঘর গৃহকর্মী সামলে চাল ডাল তেল নুনের হিসেব মিলিয়ে আমাদের জন্য তাঁর তেমন সময় মিলতো না। তারপরও বর্ণমালা আর নামাজ দোয়ার হাতেখড়ি তাঁর হাতেই। কিন্তু শাসন করা বা নজরদারি করা তাঁর স্বভাবে ছিল না, এখনও নেই। একাজে দাদুই সর্বেসর্বা। দাদুর বিদ্যার দৌড় বাল্যশিক্ষা পর্যন্ত। বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল উর্দু, ফার্সি কবিতা পাঠে। নজরদারিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি ওই বয়সেও।
একদিন সময় হয় আমাদের গ্রাম ছাড়ার। কর্তৃত্ব এবার বাবার হাতে। সামরিক কায়দায় ঘড়ি ধরে দিনযাপনের শুরু। বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাড়ি। দূরত্ব হাঁটাপথ। দুপুরে বিরতির সময় বাড়ি এসে ভাত খেয়ে যাই। রিকশা লাগে না। তাই লাগে না হাতখরচও। স্কুল ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা বাদাম ও আচারের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকাই সার। বন্ধুদের কল্যাণে দু’একবার অবশ্য চেখে দেখার সুযোগ হয়েছিল। এমনই কপর্দকশূন্য অবস্থায় পাড়ি দিই বিশ্ববিদ্যালয়ও। বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। দুপুরে ক্লাস শেষে ঘরে ফিরে ভাত খাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুপড়ি, মউর দোয়ান, স্টেশন চত্বরসহ আনন্দে মাতার যত উপাদান সবই যেন সীমানার বাইরে। কেউ বলেনি ওদিকে যেও না। তবু কেন যেন ভয় হতো- এই বুঝি সীমা লঙ্ঘিত হল। দু’একবার বন্ধুদের চাপে পড়ে যাইনি, তা নয়। তবে তীব্র একটা অস্বস্তি ঘিরে রাখতো। আনন্দটা তেমন উপভোগ্য হতো না।
আমার বাবার কাছে লেখাপড়াটাই প্রধান। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন তিনি। ‘মন্ত্রের সাধন না হয় শরীর পতন’-এই তাঁর মুলমন্ত্র। সবসময় বলেন, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। ছাত্রজীবনে কঠোর শৃঙ্খলার পাশাপাশি চলতো কৃচ্ছতাসাধন। ঈদের বাইরে বছরে দু’সেট জামা। নতুন জুতো মিলত আগের জোড়া ছিঁড়ে যাবার পর। যে বছরে দাদুকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি পড়তো সেবছরের ঈদে আর নতুন জামা হতো না। রাত জাগা ছিল অপরাধের সমতুল্য। সকালে দেরিতে শয্যাত্যাগ তো রীতিমত গুনাহ’র কাজ। ‘ঊধৎষু ঃড় নবফ ধহফ বধৎষু ঃড় ৎরংব, সধশবং ধ সধহ যধঢ়ঢ়ু যবধষঃযু ধহফ রিংব’- শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে শৈশবেই।
এভাবে দিন মাস বছর যায়। একদিন শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষকের খাতায় নাম লেখালাম। ব্যাংকে নিজের হিসেব নম্বরে মাসে মাসে টাকা আসে। মাথা খারাপের অবস্থা; এতো টাকা দিয়ে কি করবো! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের মাসোহারা তখন ৪৩০০ টাকা। কত কৌশল করে নাম দস্তখত করে টাকা উত্তোলন করি। চেক লিখতে ভুল হয়ে যায়। বাবার বকা খাই। প্রথম কয়েক মাসের জন্য বাবা ফর্দ করে দেন- কাকে কত মানিঅর্ডার করতে হবে। শৈশবের শিক্ষক থেকে শুরু করে দাদু নানু সহ জীবিত যত বুড়োবুড়ি আর কিছু নিকটাত্মীয়দেরকে বাবার নির্দেশনা মতো টাকা পাঠিয়ে মাস শেষে হাত আগের মতোই খালি। তাতে কি? এখনও বাপের হোটেলে মায়ের হাতের রান্না খাই। খাওয়া পরার ভাবনা তো নেই।
আমার মা আবার রাঁধাবাড়া, গৃহসজ্জা বা রূপচর্চা বিষয়ে কোনো শিক্ষাই আমাদেরকে দেননি। পাড়া প্রতিবেশীরা তারজন্য দু’চার কথা শোনাতে ছাড়েননি- ‘ভাবী আপনার মেয়েরাতো রাঁধা, চুল বাঁধা কিছুই শেখেনি’। আম্মা কেবল একটা কথাই বলতেন- ‘সময়ই সবকিছু শিখিয়ে দেবে’। আমাদের লেখাপড়া, ধর্মকর্ম নিয়েও আমার মায়ের বাড়তি কোনো উদ্বেগ ছিলনা। তবে বইপত্র বা খবরের কাগজে পড়া কোনো উক্তি, বাক্য বা কবিতার কোনো পংক্তি মনে ধরলে একটা চিরকুটে লিখে যত্ন করে তুলে রাখতেন আমাদেরই জন্য। এখনও রাখেন। অযাচিতভাবে উপদেশ না দিয়ে শুধু এইটুকু বলেন- এই কথাটা খুবই ভালো লেগেছে। ‘সততা ও দায়িত্ববোধ তোমাকে কর্মক্ষেত্রে সবার আগে নিয়ে যাবে/ উদ্ধত নয়, বিনয়ী হও/ কারো মনে তুমি দিও না আঘাত সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে’- মায়ের হাতে লেখা এরকম অসংখ্য চিরকুট আমার দেরাজে জমা আছে। আমার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের উক্তি- ‘এমন জীবন তুমি করিও গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’ ।
প্রভাষক হিসেবে বছর না ঘুরতেই বাবার বাড়ির পাঠ চুকলো আমার। বাড়ি বদল হলো। অচেনা কিছু মানুষ জড়িয়ে গেল জীবনের সঙ্গে। কিন্তু বাবার নজরদারি আগের মতোই বহাল রইলো। প্রথম বৈঠকেই জামাতার নিকট বড় কন্যার বিরুদ্ধে আব্বার অভিযোগ ‘ও কিন্তু ঠিকমতো লেখাপড়া করে না। ওর দিকে খেয়াল রাখবে’। দেখতে দেখতে বাইশ বছর হয়ে এল। আমার বাবার আদেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন আজও। মনে পড়ে তাঁর সঙ্গে প্রথম বেড়াতে যাওয়ার কথা। সৈকতের বেলাভূমিতে বিকেল না পেরোতেই কানে বেজে উঠে বাবার উপদেশ- ‘লোকালয় ছেড়ে বেশীদূর যাবে না, সূর্য ডোবার আগেই ঘরে ফিরবে’। তাঁকে সেকথা জানাতেই চমকে ওঠেন। তবে বিন্দুমাত্র যুক্তিতর্ক প্রদর্শন না করে ‘শ্বশুরের আদেশ শিরোধার্য’ বলে পান্থনিবাসের পথে পা বাড়ান। কারণ তিনিও বেড়ে উঠেছেন অনেকটা একইরকম পারিবারিক আবহে। তাঁদের বাড়িতে ‘সূর্যাস্ত আইন’ ছেলেমেয়ে সবার জন্যই প্রযোজ্য ছিল।
সেই ‘সূর্যাস্ত আইন’ আজও আমরা মেনে চলার চেষ্টা করি। একান্ত জরুরি কাজ না থাকলে দিনের আলো থাকতেই ঘরে ফিরে আসি। প্রবাস জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কোনোদিন মনে হয়নি আমার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কোনোদিন মনে হয়নি আমি বঞ্চিত হয়েছি। অবশ্য ছেলেবেলায় জামা জুতোর দীনতা নিয়ে কিঞ্চিৎ হীনমন্যতায় ভুগিনি, তা নয়। কতো যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ সেই সময় করেছি নিজের সঙ্গে! তখন মনে হতো যেদিন আমার টাকা হবে শত শত জামা জুতো কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলবো। কিন্তু এখন ইচ্ছে করে না। প্রয়োজনের বেশী কিছু নিতেই গেলেই খচখচ করে বুকের ভেতর। বাবার কণ্ঠ নকল করে মেয়েকে শোনাই- Cut your coat according to your cloth .. আরও আছে- For every drop of water you waste, you must know that somewhere on earth someone is desperately looking for a drop of water। তবে বেশী বেশী বলা যায় না, পাছে তিনি (কন্যা) মনক্ষুণ্ন হন। সেকালের সঙ্গে একালের কতোই না তফাৎ !
যুগ বদলেছে, কথাটা সত্য। কিন্তু তাই বলে আমাদের সন্তানদেরকে আমরা কিছুই দিয়ে যাবো না? ওদের আরামবিলাস আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশায় কেবল রাশি-রাশি অর্থব্যয় করে পিতামাতার কর্তব্য সমাধা করছি বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করবো? ওদেরকে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখাবো না? কৃচ্ছতাসাধনের কথা বলবো না? আমাদের মূল্যবোধ, দর্শন, ঐতিহ্য ওদের মাঝে ছড়িয়ে দেবো না? শেকড়ের কথা জানাবো না ওদেরকে? যুগের দোহাই দিয়ে ওদের ভাসিয়ে দেব? রাশ টেনে ধরবো না? আধুনিকতার নামে আমাদের ছেলেমেয়েরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাত ভোর করে ঘরে ফিরবে, কেউবা অন্তর্জালে ঘুরে ঘুরে সুবেহ সাদিকের আগে/পরে বিছানায় যাবে, আর দিবসের মধ্যভাগ পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোবে, আর আমরা ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে ভেবে চোখ কান বুজে রাখবো ? কতো স্বপ্ন আমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে! দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে নাম কুড়োবে, সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু ওদেরকে সততা ও মানবিকতা, সর্বোপরি শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ দিতে না পারলে সব স্বপ্নসৌধই যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
জীবনের সুবর্ণ তিথিতে পা দেবার প্রাক্বালে এই আমার উপলব্ধি- নিয়ম ভাঙার মধ্যে স্বাধীনতার স্বাদ লুকিয়ে থাকে না। প্রবাসে গিয়ে যা আরও গভীরভাবে অনুভূত হলো। কারণ উন্নত দেশে শৃঙ্খলাই প্রধান বাহন। অপচয় হয় না বললেই চলে। আর ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জাগে’ আমরা নই, তারাই সত্য বলে মানে। এসবই তাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি, সাফল্যের চাবিকাঠি। তাদের মতো হতে গিয়ে আমরা কোন পথে চলেছি, তা আমরা নিজেরাই জানি না।
পুনশ্চ: শৃঙ্খলা কিন্তু আমাদেরকে শৃঙ্খলিত করে না। স্বাধীনতার নামে একজনের বেপরোয়া আচরণ যখন অন্যের শান্তি ও স্বাধীনতা হরণ করে, তখন সেই স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রাত্যহিক জীবনে শৃঙ্খলা পরিবারে শান্তি আনে, স্বস্তি আনে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে পরিবারের সদস্যরা। পরিবার তো সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র। পরিবারের নীতিমালা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে চালু হলে জনগণের মঙ্গল বৈ অমঙ্গল হবে না। চলমান অস্থিরতার এই গ্রহণকালে, দহনকালে বড় প্রশ্ন এটাই- আমরা কি সত্যই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, না সুযোগসন্ধানী? আমরা যেমন করে বাবা মা আর পূর্ববর্তী প্রজন্মকে স্মরণ করি, তাঁদের দেখানো পথে পথ চলার অঙ্গীকার করি, আমাদের সন্তানরা কি আমাদেরকে তেমনি করে মনে রাখবে? না কি আমরা চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে সব ভুলে যাবে? আমাদের লিগ্যাসি (পরম্পরা) কি এখানেই শেষ হয়ে যাবে? এর দায় কি ওদের ? আমাদের নয়?