শূন্যরেখায় ক্যাম্পের সর্বশেষ অংশও পুড়ল আগুনে

থামেনি গোলাগুলি, তুমব্রু গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা

নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি ম | শনিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু গ্রামটি যেন মিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিণত হযেছে। কোনারপাড়ার ওপারে শূন্যরেখার অস্থায়ী এ রোহিঙ্গা শিবিরটিতে আর একটি ঘরও দাঁড়িয়ে নেই শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ। এখন সবই অঙ্গার হয়ে পড়ে রয়েছে এখানে। বাস্তুহারা সোয়া ৪ হাজার রোহিঙ্গা এখন তুমব্রু গ্রামের বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে।

অনেকে নতুন তাঁবু গেঁড়ে নতুন শিবির স্থাপন করছে। আবার অনেকে ছোট দলে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের আশাপাশের সোসাইটিতে। আবার অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এদিকে আরসা ও আরএসওর মধ্যে গোলাগুলি এখনও চলছে থেমে থেমে। লোকজন এ কারণে চাপা আতংকে। আর শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুনে জ্বলছে ক্যাম্পের উত্তরের সর্বশেষ অংশ। প্রায় শতভাগ পুড়ে গেছে এ ক্যাম্পটি। যে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার দোষ চাপাচ্ছে রোহিঙ্গা ভিত্তিক সন্ত্রাসী দু’দলের সদস্যরা পরস্পরকে। গতকাল সরেজমিন পরিদর্শনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

পুড়ে যাওয়া ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মাঝি মো. ছাদেক জানান, বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৩ দিনে এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৬শ ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাস্তুুহারা হয়ে পড়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীপুরুষ। ৩ দিন ধরে তারা খোলা আকাশের নিচে উপোস রয়েছে।

তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ অবস্থার জন্যে সহায়তা চান। তিনি আরো জানান, তাদের ক্যাম্পে ২০ প্রতিষ্ঠান ছিলো সব পুড়ে গেছে। এর মধ্যে ২ টি বড় মসজিদ, বাকিগুলো ছোটখাটো মসজিদইবাদতখানামক্তব। আর বুধবারের ঘটনায় তার দুই ছেলে হারিয়ে গেছে। তাদের একজনের নামবুরহান উদ্দিন (), অপরজনমোহাম্মদ জুবাইর ()। তারা ৩ দিন ধরে নিখোঁজ।

এখন তার পরিবার তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে ৩ দিন।

৭০ বছরের বৃদ্ধ মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, তাদের কি দোষ? কেন তাদের বাড়িঘর পোড়ানো হলো? তার কথা, কেউ বলছে আরসা আবার কেউ বলে আরএসও এ জঘন্যতম কাজ করেছে।

কিন্তু প্রকৃত কারা এ বাড়িঘর পোড়ালো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে তদন্ত দাবি করেন তিনি। বৃদ্ধা রহিমা, মৌলানা হামিদুল্লাহ, জলিল মাঝি, হাবিব ও মো. জুবাইর সহ সবার একই দাবি। ক্যাম্পের মাদরাসা শিক্ষক মৌলানা নজির আহমদ বলেন, তিনি আলআহকাম মসজিদ ও মাদরাসার শিক্ষক। তার এ প্রতিষ্ঠান পুড়ে গেছে। কারা পুড়িয়েছে তা বলতে নারাজ।

অপরদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, আরসা প্রধান আতাউল্লাহর প্রধান সহযোগী দিল মোহাম্মদ ও তার ছেলে। এ ক্যাম্পে সোয়া ৪ হাজার ক্যাম্পের মধ্যে আরসা বা আলইয়াকিনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬শ। সবাই দিল মোহাম্মদের ছেলের কমান্ডে চলে। তাকে জিজ্ঞাসা করলে সব বেরিয়ে আসবে।

কারা এ কাজ করলো? তারা বলেন, কোনারপাড়া নো ম্যান্স ল্যান্ডের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জল্লাদ ছিলো, জেলখানা ছিলো, ইয়াবা ব্যবসা ছিলো, স্বর্ণকারবার ছিলো। এমন কি নারী ব্যবসাও ছিলো। এ পয়েন্ট ছিলো অপরাধ সংঘটনের স্বর্গরাজ্য। এখন সেই অপরাধ রাজ্যের পতন হয়েছে। তবে চরম দুর্দশায় পড়েছে এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা। তারা এখন ঘুমধুম তুমব্রু গ্রামের আনাচেকানাচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

তুমব্রু গ্রাম পুলিশ আবদু জাব্বার বলেন, কোনারপাড়ার ঘর পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ প্রাইমারি স্কুলে কেউ বা অন্যত্র। আগে তুমব্রুর ২০% মানুষ অসুবিধায় ছিলো। এখন সবাই। কারণ আশ্রিত এ রোহিঙ্গাদের খাবারদাবার, পায়খানাপ্রশ্রাব, চালচলন তুমব্রুর পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে।

পাশাপাশি খোলা আকাশের নিচে তারা রাত যাপন করায় মানবতার বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, তুমব্রু গ্রামটি যেন এখন মিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তারা তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তুমব্রু গ্রামের বিভিন্ন বসতবাড়ির পেছনে বা ঝুপড়ির আনাচেকানাচে আশ্রয় নিয়েছে। আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নজরদারিতে রেখেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। পরিষদের লোকজন সর্তক আছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) মো. শাহজাহান বলেন, শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা তুমব্রু গ্রামে আশ্রয় নেয়ার খবরে পুলিশ সর্তক রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোমেন শর্মা জানান, তুমব্রুতে যা ঘটেছে সে বিষয়ে তিনি সতর্ক আছেন। তবে বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব যেহেতু আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর, তাদের এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো আহ্বান জানান। এ বিষয়ে বিজিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, গত বছর ১৪ নভেম্বর কোনারপাড়া জিরোলাইন রোহিঙ্গা শিবিরে র‌্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজার ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এতদিন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাভিত্তিক দুই সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গত বুধবার গোলাগুলি শুরু হয়। যা এখনও চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্ণফুলী পাড়ের ১০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
পরবর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনে ৯ রিসোর্টের নির্মাণ কাজ বন্ধ, ১০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ