যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য নীতিতে বড় ধরনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির ধারাই ওলটপালট করে দিয়েছেন। তার প্রস্তাবিত শুল্ক পরিকল্পনা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নয়, ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেও দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সেই শুল্ক পরিকল্পনা বা অন্তত তার একটি বড় অংশই আপাতত হিমঘরে। কারণ, বেশিরভাগ দেশেই উচ্চহারের শুল্কারোপ ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। ফলে প্রশ্ন উঠেছে এই আংশিক পিছু হটা কি ট্রাম্পকে তার মূল বাণিজ্য লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে দিয়েছে? ট্রাম্পের ৫টি মূল বাণিজ্য লক্ষ্য এবং সেগুলো এখন কি অবস্থায় আছে তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।
আরও ভাল বাণিজ্য চুক্তি করা : ট্রাম্পের কথায়, যুক্তরাষ্ট্র দশকের পর দশক ধরে লুটতরাজের শিকার হয়েছে। কাছের কিংবা দূরের শত্রু কিংবা মিত্র সবাই যুক্তরাষ্ট্রকে লুটে নিয়েছে। সেই লুটতরাজের বিরুদ্ধেই সাজা দিতে ট্রাম্প তার বাণিজ্য পরিকল্পনায় প্রথমেই বিশ্বের সব দেশের পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক এবং দাগী হিসাবে চিহ্নিত করা ৬০টি দেশের ওপর অতিরিক্ত পারস্পারিক শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত নেন। খবর বিডিনিউজের।
এতে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু–মিত্র সব দেশই অর্নীতিতে ধাক্কা লাগা নিয়ে উদ্বেগে পড়ে এবং বেশ কিছু দেশ আলোচনার পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। চুক্তি করতে ট্রাম্পের সঙ্গে বিশ্ব নেতাদের যোগাযোগ এবং বাণিজ্য ছাড়ের প্রস্তাব নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা গর্বই করেছে হোয়াইট হাউজ।
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসান্ট জানিয়েছেন, অন্তত ৭৫টি দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা শুল্ক নিয়ে আলোচনায় বসতে চেয়েছে। ট্রাম্প তার ভাষায় বলেছেন, বিশ্বনেতারা এখন আমাকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করছেন। অনেকে ফোন করছেন। চুক্তি করার জন্য আমাকে খুশী করছেন। যে কোনও কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে মরিয়া।
দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ না করলেও যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ইতোমধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা শুরু করেছে।
মূলকথা : ট্রাম্প বেশিরভাগ দেশেই উচ্চহারের শুল্ক আরোপ আপাতত স্থগিত করায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলো কোনও ধরনের চুক্তিতে পৌঁছতে ৯০ দিন সময় পাচ্ছে। সময় দ্রুতই চলে যাচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আলোচনা চলছে। আর তাতে এই ইঙ্গিতই মেলে যে, ট্রাম্প তার চেষ্টায় কিছু একটা পেয়ে যাওয়ার ভাল সুযোগ রয়েছে।
দেশীয় শিল্পের প্রসার : ট্রাম্পের কথায়, তার দেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর অন্যায় বাণিজ্য চর্চার শিকার হচ্ছে। ফলে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের চাকরি ও শিল্প খাত চাঙ্গা হবে বলেই তিনি মনে করেন।
ট্রাম্প দশকের পর দশক ধরে বলে আসছেন, বিদেশি অন্যায় প্রতিযোগিতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে সুরক্ষা দিয়ে তা পুনরায় গড়ে তোলার কার্যকর পন্থা হচ্ছে শুল্ক। কিছু কারখানা হয়ত বিদ্যমান সুযোগ–সুবিধা দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হতে পারে। স্বতন্ত্র আরও প্রচেষ্টা হয়ত সময় নেবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল পরিবেশ দরকার। অথচ ট্রাম্প গত সপ্তাহজুড়ে যেভাবে শুল্ক বাড়ানো এবং পরক্ষণেই তা আবার স্থগিত করেছেন তা ব্যবসার পরিবেশের জন্য স্থিতিশীল নয়।
এখন কেউই বড় ধরনের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে না, কারণ পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল। এ মুহূর্তে এটি ধারণা করা কঠিন যে, শুল্কের চূড়ান্ত মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং কোন কোন শিল্প সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা পাবে। আজ হয়ত এ সুরক্ষা পেতে পারে গাড়ি বা স্টিল খাত। আবার কালই হয়তো তা পাবে উচ্চ–প্রযুক্তির বৈদ্যুতিক কোম্পানিগুলো।
মূলকথা : ট্রাম্পের শুল্কারোপ এবং তা স্থগিতের পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিদেশ– উভয় ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলো এখন বড় ধরনের কোনও কথা দেওয়ার আগে পরিস্থিতি থিতু হওয়ার অপেক্ষায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
চীনকে মোকাবেলা : ট্রাম্প বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শিকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি। চীনকেও অনেক শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে। গত বুধবার ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক ঘোষণার সময় মার্কিন অর্থমন্ত্রীসহ হোয়াইট হাউজের কয়েকজন কর্মকর্তা সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন, ট্রাম্পের লক্ষ্য হল আসল খলনায়ক চীনের ওপর হাতুড়ি মারা।
সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বেসান্ট বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যে তারাই (চীন) সবচেয়ে বড় সমস্যা। বাদবাকি বিশ্বের জন্যও তারা সমস্যা। তবে ট্রাম্প অবশ্য সেদিন বাণিজ্য নিয়ে বর্তমানের এই বিবাদের জন্য চীন নয় বরং আগের মার্কিন প্রশাসনগুলোকেই দায়ী করেছিলেন।
এর আগের দিনই হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব লেভিট বলেছিলেন, চীন চুক্তি করার জন্য যোগাযোগ করলে ট্রাম্প খুবই উদারভাবে তা বিবেচনা করবেন। কিন্তু ট্রাম্পের একের পর এক শুল্ক বোমার মুখে বহু দেশ আলোচনার পথে হাঁটার আগ্রহ দেখালেও চীন মাথা নত করেনি। বরং উল্টো শেষ পর্যন্ত লড়ার অঙ্গীকার করেছে। আর এরপর থেকে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধও কেবলই তীব্র হয়েছে। তবে বিশ্বের দ্বীতিয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের এই যুদ্ধ বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে চলতে থাকলে এমন ধরনের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের যে মিত্রদেরকে সবচেয়ে বেশি দরকার পড়বে, তাদের থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
রাজস্ব আয় বৃদ্ধি : ট্রাম্প বলেছেন, এখন আমাদের সমৃদ্ধশালী হওয়ার পালা। আর তা করতে গেলে কর কমানো, জাতীয় ঋণ পরিশোধে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার কাজে লাগাতে হবে। আর তা খুব শিগগিরই হবে। গতবছর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্প প্রতিনিয়তই বলে এসেছিলেন, তার প্রস্তাবিত শুল্ক বড় ধরনের নতুন রাজস্ব বয়ে আনবে। আর যুক্তরাষ্ট্র তখন বাজেট ঘাটতি কমানো, কর কর্তন এবং নতুন সরকারি কর্মসূচির জন্য সেই অর্থ কাজে লাগাতে পারবে।
স্বাধীন ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের গতবছরের এক গবেষণায় আনুমানিক হিসাব দিয়ে বলা হয়েছে, ট্রাম্প সব দেশের পণ্যে প্রাথমিকভাবে ঘোষিত সর্বজনীন যে ১০ শতাংশ শুল্ক অন্তত আগামী ৯০ দিনের জন্য বহাল রেখেছেন, তাতে আগামী ১০ বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলার নতুন রাজস্ব আয় হবে। তবে এটি আগামী ১০ বছরে কর কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় অনেক কম হবে বলে জানিয়েছে, ওয়াশিংটনের থিংকট্যাংক ‘বাইপার্টিজান পলিসি সেন্টার’।
মূলকথা: ট্রাম্প আরও বেশি শুল্ক রাজস্ব চান। তিনি যদি সব দেশের পণ্যে প্রাথমিক ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখেন আর এর সঙ্গে কিছু আমদানি পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর করেন এবং চীনের পণ্যের ওপর আরও বেশি শুল্ক রাখেন– তাহলে তিনি রাজস্ব আয় পাবেন, অন্তত যতক্ষণ না মার্কিনিরা বেশিমাত্রায় দেশীয় পণ্যের দিকে ঝুঁকে ততক্ষণ পর্যন্ত।
ভোক্তাদের জন্য কম দাম : ট্রাম্প বলেছেন, শেষমেষ যুক্তরাষ্ট্রে বেশি উৎপাদন শুরু হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম কমে আসবে। সেটি হবে আমেরিকার জন্য স্বর্ণযুগ। বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা অবশ্য গত সপ্তাহে বাণিজ্যে ট্রম্পের আগ্রাসী শুল্ক নীতির ব্যখ্যায় অন্য আরও নানা উদ্দেশ্য সামনে এনেছেন। তবে ট্রাম্প কেবল মার্কিনি ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম কমানোর কথাই বারবার বলেছেন এবং তার বাণিজ্য নীতি এতে সহায়ক হবে সেই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ট্রাম্প তার শুল্ক পরিকল্পনা ঘোষণার পর পরই জ্বালানির দাম কমেছিল। তবে সেটি হয়ে থাকতে পারে বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বে মন্দা ডেকে আনতে পারে তা নিয়ে আশঙ্কার ফলে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাস্তবে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতিতে ঘটতে পারে উল্টোটা। বেড়ে যেতে পারে ভোক্তা মূল্য। শুল্ক মূলত আমদানি করা পণ্যের ওপর বাড়তি খরচ চাপায়, যেটি শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই বর্তায়।
ট্যাঙ ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, ট্রাম্পের বহাল রাখা ১০ শতাংশ সার্বজনীন শুল্ক প্রথম বছরেই মার্কিন পরিবারগুলোর গড় ব্যয় ১,২৫৩ ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। আর এই চাপ সবচেয়ে বেশি পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষদের ওপর।
মূলকথা: পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ভুল পথে ছুটে যাওয়া তীরের মতো। আর তা রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পের অবস্থান এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার দলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।