সমুদ্রের পরিবেশগত দূষণ কমাতে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রগামী জাহাজে লো-সালফার মেরিন ফুয়েল ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক আগেই। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের বন্দরে যাতায়াতকারী সমুদ্রগামী জাহাজে বাঙ্কারিং দেওয়ার জন্য প্রথম বারের মতো ১৫ হাজার টন লো-সালফার মেরিন ফুয়েল আমদানি করার চার মাসেও বিপণন শুরু হয়নি। শুল্কায়ন জটিলতার কারণে বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্যাংকে আটকা আছে ৬০ কোটি টাকার মেরিন ফুয়েল। শুধুমাত্র শুল্কযুক্ত শব্দটির স্থলে শুল্কমুক্ত করে নীতিমালা সংশোধন করতে সময়ক্ষেপণের কারণেই সমস্যাটির সমাধান হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা যায়, বাংলাদেশের বন্দরে যাতায়াতকারী সমুদ্রগামী জাহাজে দীর্ঘদিন ধরে তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ সালফার ফুয়েল বাঙ্কারিং সুবিধা ছিল। বিশ্বের উন্নত অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে বাঙ্কারিংয়ে জ্বালানির দাম বেশি হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিদেশী জাহাজগুলোতে বাঙ্কারিং বন্ধ থাকে।
এদিকে আন্তর্জাতিক নৌ-নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) বিশ্বব্যাপী সমুদ্রগামী জাহাজের সালফার নিঃসরণ কমানোর জন্য তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ (৩.৫০%) সালফার ফুয়েল অয়েলের পরিবর্তে লো-সালফার হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) হিসেবে দশমিক ৫ শতাংশ (০.৫০%) মেরিন ফুয়েল বাঙ্কারিং করার নির্দেশনা দেয়। ধারাবাহিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সরকার ‘বাংলাদেশের জলসীমায় যাতায়াতকারী দেশী বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজে জ্বালানি সরবরাহের জন্য বাঙ্কারিং নীতিমালা’ গেজেট প্রকাশ প্রকাশ করে। তবে পার্শ্ববর্তী অনেক বন্দরের চেয়ে চট্টগ্রামে মূল্য বেশি হওয়ায় বাঙ্কারিংয়ে অনীহা ছিল বিদেশী জাহাজের। অন্যদিকে মুজিব শতবর্ষকে স্মরণীয় করতে নানান পদক্ষেপের অংশ হিসেবে লো-সালফার মেরিল ফুয়েল আমদানির উদ্যোগ নেয় বিপিসি। চলতি অর্থবছরের শুরুতে দেড় লাখ টন মেরিন ফুয়েল আমদানির পদক্ষেপ নেয় বিপিসি। ৭৫ হাজার টন সরাসরি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এবং ৭৫ হাজার টন ‘জি টু জি’ পর্যায়ে আমদানি হবে। প্রথম ধাপে ১৫ হাজার টন লো-সালফার মেরিন ফুয়েল আমদানি করা হয়। সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থাই জাহাজ ‘এমটি টিএমএন প্রাইড’ মেঘনা অয়েলের ৫নং ডলফিন জেটিতে আসে। দুইদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির বন্ডেড ট্যাংকে এসব মেরিন ফুয়েল খালাস শেষ হয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েকদফা মেরিন ফুয়েলের দর নির্ধারণ হয়। পরে আমদানিকৃত মেরিন ফুয়েল খালাসের পর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের ছাড়পত্র নিতে গেলে বিপত্তি তৈরি হয়। এসময় বিপিসি শুল্কমুক্ত সুবিধায় শুল্কায়ন করতে চাইলে নীতিমালায় ‘শুল্কযুক্ত’ থাকার কারণে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কমুক্ত সুবিধায় ছাড়পত্র দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে চিঠি দেয় বিপিসি। এরপর নীতিমালা সংশোধনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাথে বৈঠক করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ওই বৈঠকে বিপিসি ও কাস্টমসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় শুল্কমুক্ত করে বাঙ্কারিং নীতিমালা সংশোধনের। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে এনবিআরকে চিঠিও দেওয়া হয়। এরমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় এক মাস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর মেরিন ফুয়েল আমদানি হলেও বিপণন করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় তিন মাস ২০ দিন পার হয়েছে, এখনো আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচে নীতিমালার একটি শব্দ সংশোধন সম্ভব হয়নি। ফলে ৬০ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১৫ হাজার টন মেরিন ফুয়েল। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু কারো যেন দায় নেই।’
এ ব্যাপারে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) মো. সামসুদ্দোহা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বাঙ্কারিং নীতিমালায় জটিলতার কারণে কাস্টমস ছাড়পত্র নেওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে এখনো বিপণন সম্ভব হচ্ছে না। বাঙ্কারিং নীতিমালায় বর্তমানে মেরিন ফুয়েল শুল্কায়নের ক্ষেত্রে শুল্কযুক্ত লেখা রয়েছে। কিন্তু এটি শুল্কমুক্ত হওয়ার কথা ছিল। বিপিসির পক্ষ থেকে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থবিভাগের সাথে বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে কাস্টমসের প্রতিনিধিরা বিষয়টি শুল্কমুক্ত হবে বলে মতামত দিয়েছেন। মিটিংটা হয়েছে প্রায় এক মাস আগে। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এ বিষয়টি সংশোধনের জন্য চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো চিঠি পাইনি।’