বে টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করে শর্তাবলী ঠিক করে দেওয়ার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বহুল প্রত্যাশার এই বন্দর নির্মাণের মূল বাধাগুলোও কেটে যাচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে সরকারি খাস জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার পাশাপাশি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) বিদেশি বিনিয়োগে চারটি টার্মিনাল নির্মাণের ব্যাপারেও দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। প্রকল্পটির জটিল ও দেশের জন্য নতুন ধাঁচের কাজ ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ এবং চ্যানেল খননের খরচ যোগাতে প্রয়োজনীয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সংস্থান হয়েছে। পুরো প্রকল্পের বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি বিদেশি আরো একটি সংস্থা এই বন্দরে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে।
বন্দর সূত্র জানায়, পিপিপিতে নির্মাণাধীন চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বে টার্মিনাল নির্মাণ কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর হচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে প্রয়োজনীয় জায়গার সংস্থান হওয়ার পর প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রমে গতি আসতে শুরু করেছে। বন্দরের চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ বড় বে টার্মিনাল নির্মাণের শুরুতে ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ হালিশহরের উপকূলীয় এলাকার একটি চর ঘিরে চ্যানেল এবং ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করা হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করে বন্দরসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের জন্য ব্যাপারটি নতুন। মাতারবাড়িতে বন্দর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রথম বড় ধরনের ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের অভিজ্ঞতা লাভ করে বাংলাদেশ। বে টার্মিনাল নির্মাণের ক্ষেত্রে সাগরে বড় একটি বাঁধ নির্মাণ করে স্রোত ঠেকিয়ে চ্যানেল নির্মাণ করা হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ৮ ফুট উঁচু করে এই ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করা হবে। এই চ্যানেলেই তৈরি হবে চারটি টার্মিনাল। বিশ্বে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্রেক ওয়াটার নির্মিত হয়। চট্টগ্রামে কী ধরনের ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হবে ইতোমধ্যে তার পরীক্ষা–নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের মাধ্যমেই বে টার্মিনালের অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ শুরু করতে হবে। চ্যানেল ও জেটিসহ আনুষাঙ্গিক কাজগুলো ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের আগে করা যাবে না। কিন্তু ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল তৈরির জন্য প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সংস্থান প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল। এই টার্মিনালে বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আগ্রহ প্রকাশ করলেও তারা মূল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে চায়; ব্রেক ওয়াটার বা চ্যানেল তৈরিতে নয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপারটি ঝুলে ছিল। ইতোমধ্যে দুবাই পোর্ট, আবুধাবি পোর্ট কিংবা সিঙ্গাপুর পোর্টের মতো প্রতিষ্ঠান বে টার্মিনালের স্বতন্ত্র টার্মিনাল নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলেও তারা ব্রেক ওয়াটার বা চ্যানেল তৈরিতে বিনিয়োগ করবে না বলে জানায়। অর্থাৎ বিদেশি বন্দরগুলো নিরাপদ চ্যানেল পেলেই কেবল তাতে বন্দরের অবকাঠামো এবং ইকুইপমেন্টসহ আনুষাঙ্গিক খাতে বিনিয়োগ করে বন্দর পরিচালনা করবে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায় থেকে কোনো বিনিয়োগে যাবে না।
পরে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসে। সম্ভাবনাময় প্রকল্পটিতে অর্থায়নে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংক ৬৫০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই টাকা বে টার্মিনালের ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরিতে ব্যবহার করা হবে।
বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলেছে, বে টার্মিনালে মোট চারটি জেটিসহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। এর প্রথম দুটি টার্মিনাল নির্মাণে প্রতিটির জন্য ১৫০ কোটি ডলার করে মোট ৩শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর পোর্ট) এবং আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড বা দুবাই পোর্ট। এছাড়া আবুধাবি পোর্টস ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করবে। বে টার্মিনালের চতুর্থ টার্মিনালটিকে লিকুইড টার্মিনাল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এখানে জ্বালানি তেল খালাস এবং মজুদসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে কথাবার্তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক গতকাল আজাদীকে বলেন, বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসায় বে টার্মিনাল বাস্তবায়ন প্রকল্পে নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে। ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরির সমুদয় অর্থ বিশ্বব্যাংক দেবে। এছাড়া বিদেশি যেসব বন্দর এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তাদের সাথে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় ঠিক করার জন্য আমাদের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।