মানবের দুঃখমুক্তির পথ প্রদর্শক মহাকারুণিক তথাগত গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। শাক্যবংশীয় কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদন ও রানী মহামায়ার সন্তান ছিলেন তিনি। বুদ্ধ পূর্ণিমার পুণ্যময় এক মহান তিথিতে রাজকুমার সিদ্ধার্থ (ভাবী বুদ্ধ) হিমালয়ের পাদবিধৌত দেবদেহ নগরের সীমান্ত অঞ্চলে লুম্বিনী নামক উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন। নেপালের নৈরঞ্জনা নদীর তীরে গয়ার বোধিদ্রুমমূলে সিদ্ধার্থ গৌতম লাভ করেন বোধিজ্ঞান অর্থাৎ বুদ্ধত্ব এবং ভারতের কুশীনগরের শালবনে বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ (দেহত্যাগ) লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ লাভের মতো তিনটি ঘটনা একই তিথিতে সংঘটিত হওয়ায় এ পূর্ণিমা ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে অভিহিত। বুদ্ধের জীবনের স্মৃতি বিজড়িত পূর্ণিমাগুলোর মধ্যে বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে সমগ্র বিশ্বে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালিত হয়ে থাকে।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ রাজ-ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেই জীবন-সত্যকে উপলব্ধি করেন। তিনি মাত্র ২৯ (ঊনত্রিশ) বছর বয়সে মহামুক্তির অন্বেষণে গৃহত্যাগ করেন এবং দীর্ঘ ৬ (ছয়) বছর কঠোর তপস্যায় লাভ করেন পরম বুদ্ধত্ব। মহামতি বুদ্ধ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, জগতে কোন কিছুরই স্থায়িত্ব নেই। এ জগত সংসার দুঃখময়, অনিত্য এবং অনাত্ম; অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাই যে তৃষ্ণাজ দুঃখের মূল কারণ। বুদ্ধের মতে- শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমেই এই অবিদ্যাকে ধ্বংস করা সম্ভব। তথাগত বুদ্ধ সুদীর্ঘ ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) বছরব্যাপী জীব-জগতের কল্যাণে তাঁর অমৃতময় নৈর্বাণিকধর্ম প্রচার করেছেন। কালক্রমে জম্বুদ্বীপসহ সমগ্র পৃথিবীতে বুদ্ধের ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অমিয় বাণীর ছোঁয়ায় সমগ্র বিশ্বে নতুন এক মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটে; দিশাহীন মানবগোষ্ঠীকে দেয় সাম্য, মৈত্রী ও সংহতির এক অনুপম বার্তা। জগতপূজ্য মহাকারুণিক বুদ্ধ জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন ছিন্ন করে ৮০ (আশি) বছর বয়সে পরিনির্বাপিত হন।
পৃথিবীর ইতিহাসে তথাগত বুদ্ধের মৈত্রী-বাণীর কোন সীমা-পরিসীমা নেই। শুধু মানবজাতি নয়, পশুপক্ষী-কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে সকল প্রাণীই তাঁর অপরিসীম করুণা ও মৈত্রী থেকে বঞ্চিত হয়নি অর্থাৎ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সকল প্রাণীর প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। বুদ্ধ বলেছেন, ‘তিনি সুখী, যিনি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে ভালবাসেন এবং সবসময়ই অন্যের কল্যাণ কামনা করেন। ফুলের সৌরভ বাতাসের গতির বিপরীত দিকে যায় না; কিন্তু মানুষের গুণের সৌরভ চতুর্দিকে ছড়ায়। লোহার মরিচাই যেমন লোহাকে ধ্বংস করে, তেমনি আমাদের নিজেদের পাপই আমাদের অনিষ্টের মূল। মেঘমুক্ত আকাশ যেমন অন্ধকার রাত্রিকে আলোকিত করে, তেমনি মানুষের সৎকর্ম পৃথিবীকে উজ্জ্বল করে তোলে’।
বুদ্ধ একথাও বলেন যে- “তিনি নিজে বলেছেন বলেই যেন তাই সত্য বলে গ্রহণ না করা হয়। যদি বিবেকের কষ্টি পাথরে যাচাই করে তা সত্য বলে নির্ণীত হয়, তবেই তা গ্রহণ করো এবং তদনুযায়ী নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করো।” ‘আমার মতই সত্য, অপর সব মিথ্যা’ ইহাকে বুদ্ধ ভ্রান্ত-ধারণা বলে আখ্যা দিয়েছেন।
সার্থক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্মের অবদান সুদূরপ্রসারী। বিশ্বসভ্যতার প্রবহমান সময়ের স্রোতে মানবজাতি বুদ্ধের মাঝে অবলোকন করেছে প্রজ্ঞা, মনুষ্যত্ব ও কল্যাণের উত্থান। বুদ্ধের নৈতিক ও ব্যতিক্রমী ধর্ম-দর্শনচিন্তা শত শত বছর পেরিয়ে আজো মানবজাতির সুখ-সমৃদ্ধি ও মানবীয় উৎকর্ষতায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনই মানবজীবনের সার্থকতা, কিন্তু কৃত্রিম জীবন ও সভ্যতার দিকে মানুষ যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই লোভ, লালসা, হতাশা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আজ হিংসায় উন্মত্ত, হীন স্বার্থসিদ্ধি, বৈশ্যবৃত্তির নির্মম লুব্ধতার দিনে তথাগত বুদ্ধের স্মরণ বাঞ্ছনীয়, যিনি ছিলেন স্থির, প্রজ্ঞাবান এবং সম্মুখপথের যাত্রী। তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে রচিত গানে (রচনাকাল: ২১ ফাল্গুন, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) উপলব্ধি করেছিলেন:
হিংসায় উম্মত্ত পৃথ্বি, নিত্যনিঠুর দ্বন্দ্ব,
ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষ গ্লানি,
তব মঙ্গলশঙ্খ আন,’ তব দক্ষিণ পাণি-
তব শুভ সংগীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য,
করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য ॥
রবীন্দ্রনাথ একান্তভাবে কামনা করেন- সর্বজীবে মৈত্রীকে যিনি মুক্তির পথ বলে ঘোষণা করেছিলেন সেই তারই বাণীকে আজ উৎকণ্ঠিত হয়ে কামনা করি। পূজার বেদীতে আবির্ভূত হোন মানবশ্রেষ্ঠ তথাগত বুদ্ধ, মানবের শ্রেষ্ঠতাকে উদ্ধার করার জন্যে। বিশ্বকবির বিশ্বাস বুদ্ধের বোধন-মন্ত্র আত্মবিস্মৃত মানবজাতির চিত্তে আবার নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে:
চিত্ত হেথা মৃতপ্রায়, অমিতাভ তুমি অমিতায়ু,
আয়ু করো দান।
তোমার বোধনমন্ত্রে হেথাকার তন্দ্রালস বায়ু
হোক প্রাণবান।
খুলে যাক রুদ্ধদ্বার, চৌদিকে ঘোষুক শঙ্খধ্বনি
ভারত-অঙ্গনতলে আজি তব নব আগমনী
অমেয় প্রেমের বার্তা শত কণ্ঠে উঠুক নিঃস্বনি-
এনে দিক অজেয় আহ্বান।
আজ রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদের সকলের প্রত্যাশা হোক- বিশ্ব আজ শান্তি চায়, মানুষ বর্ণ-বৈষম্যের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি চায়। শান্তি, সমপ্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচনায় আজ মহামানব বুদ্ধের অহিংসা নীতি, গণতন্ত্রবাদ; মৈত্রী, করুণা, মুদিতা উপেক্ষার বাণী অনুশীলন অপরিহার্য। তথাগত গৌতম বুদ্ধের আদর্শকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হলে জাতিতে-জাতিতে, মানুষে-মানুষে পরস্পরের আস্থা এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে প্রকৃত শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষে নতুন পথে যাত্রা করতে হবে।
‘সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্তু’
‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার। সম্পাদক : ‘অমিতাভ’