পূজামণ্ডপে এখন বিষাদের ছায়া। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘরে ঘরে মন খারাপের দিন। ঢাক–কাসরের বাদ্যি–বাজনা, রাত উজ্জ্বল করা আরতি ও পূজারি–ভক্তদের পূজা–অর্চনায় কেবলই দেবী দুর্গার বিদায়ের আয়োজন। পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের আজ শেষদিন শুভ বিজয়া দশমী। অশ্রুসিক্ত নয়নে দেবীকে বিদায় জানানোর পালা। দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ছেড়ে ফিরে যাবেন হিমালয়ের কৈলাসে স্বামী শিবের সান্নিধ্যে।
আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮ টায় মহাদশমী বিহিত পূজা ও পূজান্তে অঞ্জলি গ্রহণের পর দর্পণ বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে বাঙালি হিন্দু সমপ্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পাঁচদিনের শারদীয় দুর্গোৎসব। মর্ত্যে পাঁচদিন মৃন্ময়ীরূপে মণ্ডপে মণ্ডপে অবস্থান করে আজ বিদায় নেবেন দেবী দুর্গা।
এদিকে শারদীয় দুর্গোৎসবের গতকাল সোমবার ছিল মহানবমী। এই দিন রাত ১২টার পর থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে আনন্দের মাঝে বিষাদের ছায়া নেমে আসে ভক্তদের মনে।
গতকাল সোমবার সকালে কল্পারম্ভ ও বিহিতপূজার মাধ্যমে শুরু হয় মহানবমীর আনুষ্ঠানিকতা। পূজা শেষে ভক্তরা দেবীর চরণে অঞ্জলি নিবেদন করেন। সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে নগরীর প্রধান পূজা মণ্ডপ জেএম সেন হলসহ হাজারী গলি পূজা মণ্ডপ, আগ্রাবাদ একতা সংঘ, সতীশবাবু লেইন, কুসুম কুমারী সিটি কর্পোরেশন পূজা মণ্ডপ, রাজা পুকুর লেইন পূজা মণ্ডপ, জামালখান পূজা মণ্ডপ, আগ্রাবাদ গোসাইলডাঙ্গা পূজা মণ্ডপ, দক্ষিণ নালাপাড়া পূজা মণ্ডপ, পাথরঘাটা দুর্গা মন্দির, চেরাগী পাহাড় পূজা মণ্ডপ, ঘাটফরহাদবেগ পূজা মণ্ডপ, এনায়েত বাজার মহিলা পরিষদ পূজা মণ্ডপসহ অন্যান্য মণ্ডপগুলোতে মহানবমীর পূজা শুরু হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় মহানবমী বিহিত পূজা শেষে ভক্তরা মায়ের চরণে অঞ্জলি প্রদান করেন। এরপর ভক্তরা প্রসাদ গ্রহণ করেন।
সনাতন ধর্মমতে, নবমীর পুণ্য তিথিতে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে বিশ্বে শুভশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দুর্গা। নবমী তিথি শুরু হয় সন্ধিপূজা দিয়ে। অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট সর্বমোট ৪৮ মিনিটে করা হয় সন্ধিপূজা। মূলত দেবী চামুণ্ডার পূজা করা হয় এ সময়। এ সময়েই দেবী দুর্গার হাতে বধ হয়েছিল মহিষাসুর, আর রাম বধ করেছিলেন রাবণকে।
পূজা মণ্ডপের পুরোহিত বিশ্বজিৎ ঠাকুর আজাদীকে বলেন, মহানবমীতে ভক্তদের দেওয়া ষোড়শ উপাচারের সঙ্গে ১০৮টি নীলপদ্মে পূজা হয় দেবী দুর্গার। এ ছাড়া নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে মহানবমীর বিহিত পূজা সম্পন্ন হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। মহানবমীতে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবীদুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়, যা আজকে (গতকাল) নবমী পূজার সময় দেয়া হয়েছে। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ হয়।
মহাষষ্ঠী পূজার মধ্যদিয়ে শুক্রবার শুরু হওয়া পাঁচ দিনের সর্বজনীন উৎসবের পর্দা নামছে আজ বিজয়া দশমীতে দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। পূজা সমাপণ ও দর্পণ বিসর্জন হবে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের মধ্যে। সন্ধ্যা–আরাত্রিকের পর প্রতিমা বিসর্জন ও শান্তিজল গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সব আয়োজন।
সরেজমিনে নগরীর এবং হাটহাজারী ও রাউজানের বেশ কয়েকটি পূজা মণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে গতকাল মহানবমীতে দিনভর গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝেও দেবী ভক্তদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। বিকেলের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মণ্ডপে মণ্ডপে নারী– পুরুষ থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ এবং শিশুরা লাইন ধরে প্রতীমা দর্শন করেছেন। রাত ৮টার পর গুঁড়িগুড়ি কমে গেলে এই ভিড় আরো বাড়তে থাকে। মণ্ডপগুলোর সামনে ভিড় সামলাতে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়।
খবর নিয়ে জানা গেছে জেলার সবগুলো পূজা মণ্ডপে নবমীর রাতে ভক্তদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। প্রতিটি মণ্ডপে ভক্তদের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত আলো এবং সিসিটিভির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সময় পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ সার্বক্ষণিক টহল ও নজরদারিতে ছিল।
পতেঙ্গায় বিসর্জন : আজ সকালে বিজয়া দশমীর পূজা শেষে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার জন্য মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিটি থানা ও পূজা কমিটিকে বলা হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন করেছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সৈকতে নামার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বিসর্জন অনুষ্ঠানে প্রতিবারের মতো এবারও প্রধান অতিথি থাকবেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। এছাড়াও সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক হিল্লাল সেনসহ পতেঙ্গা থানা পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ পূজা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত থাকবেন।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ছাড়াও পাথরঘাটা গঙ্গাবাড়ি এলাকায় কর্ণফুলীতে, কালুরঘাট এলাকায়, কাট্টলী রানী রাসমনি ঘাটে এবং আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকতেও প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হবে।