শীতকালে গ্রামেগঞ্জে পীর আউলিয়াদের ফাতেহা ওরশ হয়। এ উপলক্ষে মেলা হয়। কয়েক শ’, কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত, মিলাদ, খানাপিনা হয়। বিয়েশাদিতে এখন ক্লাবগুলোতে উপচে পড়ছে মানুষ। মেজবান, হাট বাজার, হোটেল রেস্টুরেন্ট, পর্যটন স্পট, ট্রেন বাস বিমান লঞ্চ,সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, বিচারালয় সবকিছুই চলছে আগের মত। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে গত ১১ মাসে করোনায় মারা গেছেন প্রায় ৭ হাজার মানুষ। আবার সড়ক দুর্ঘটনায়ও মারা গেছে প্রায় সমসংখ্যক মানুষ। সবই চলছে যথারীতি, বন্ধ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সরকার করোনার জন্য বিশেষ বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দিয়ে দিচ্ছে।
শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাশ করছে, শিক্ষকরাও যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছেন, অনলাইনে শিক্ষা দিতে। যেখানে নাগরিক সুযোগ সুবিধা আছে, কম্পিউটার ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন আছে, ওয়াইফাই সুবিধা আছে, সাথে অভিভাবকদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, তারা হয়তো আংশিকভাবে হলেও লেখাপড়ার ক্ষতিটা পুষিয়ে নিচ্ছেন। সরকারি ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকার থেকে যথারীতি বেতন ভাতাদি পাচ্ছেন। শহরে, যেসকল বেসরকারি নন এম পিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তারাও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করছে, শিক্ষকদের বেতনও তারা দিচ্ছেন, কারণ শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাশ নিচ্ছেন। কিন্তু, শহরে বা গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যারা পড়ে, তাদের বেশিরভাগই বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। তারা অনলাইন ক্লাশের সুযোগটা নিতে পারছে না আর্থিক সঙ্গতির অভাবে। অনেক বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। অনেকে শিক্ষকতা না থাকায় অভাবে অনটনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকার থেকে তাদের জন্য কোনও প্রণোদনা ঘোষণাও করা হয় নি। প্রান্তিক অঞ্চলের অনেক নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়ে শহরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তারা এখন গ্রামে চলে গেছে। তাদের অনেকেই শহরাঞ্চলে টিউশনি করে নিজেদের খরচ চালিয়ে পরিবারকেও আর্থিক সাহায্য করে। এখন তারা বেকার, পড়ালেখা থেকে দূরে, পরিবারের ওপর বোঝা। এতো সাতকাহন গাইবার কারণ হচ্ছে, করোনায় সবকিছুই খোলা, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কোন স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য?
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লেখাপড়ার যে ক্ষতিটা হচ্ছে, সাথে সাথে আর্থিক দুর্গতি, সরকারের অটোপ্রমোশনে কি সে দুর্গতি লাঘব হবে? গ্রামে গিয়ে দেখেছি, স্কুল কলেজ বন্ধ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও বন্ধ। শিক্ষাহীন বেকার বসে থেকে উঠতি বয়সের ছেলেরা মোবাইলে গেমের নামে জুয়া খেলছে। করোনার তুঙ্গ সময়ে যদি সরকার সবকিছু খোলা রাখেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার কথা কেন বিবেচনায় আনছেন না? লেখাপড়ার যে ক্ষতিটা এতে হচ্ছে, তা কি পোষানো আদৌ সম্ভব হবে। যদি ভাবেন, শিক্ষার চেয়েও মানুষের জীবন বাঁচানো ফরজ, তাহলে সেটা কি শুধু দরিদ্রশ্রেণীর জন্য? বন্ধ যদি রাখতে হয়, সমন্বিত চিন্তায় সবকিছু বন্ধ রাখেন, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে একটা বিশেষ শ্রেণীকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলার কোনও অর্থ হয় না।